X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুর-পল্লবীতে ফের ‘ত্রাসের রাজত্ব’ গড়তে চায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত

নুরুজ্জামান লাবু
১৬ আগস্ট ২০২০, ১১:২৪আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২০, ১৫:২৩

 শাহাদাত মাঝখানে কয়েক বছর চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে গিয়েছিল। তবে রাজধানীর মিরপুর-পল্লবীতে ফের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে পালিয়ে থাকা তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গুলির ঘটনা ঘটছে। অনেকেই ভয়ে শাহাদাতের ক্যাডারদের হাতে চাঁদার টাকাও তুলে দিচ্ছেন নীরবে। এমনকি খোদ স্থানীয় এক কাউন্সিলরও শাহাদাতকে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন। চাঁদা না দিলে পরিবারের সব সদস্যকে গুলি করে হত্যার ভয় দেখানো হয়। প্রিয়জন হারানোর ভয়ে থানা-পুলিশও করেন না অনেকেই। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে গত বুধবার মিরপুরের ভাষানটেক এলাকা থেকে অস্ত্রসহ আলোচিত এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর পাঁচ ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে রয়েছে রফিকুল ইসলাম রনি, মনির হোসেন বাবু, সাইফুল ইসলাম, শাহিন মিয়া ও সোহেল রানা। গ্রেফতারদের মধ্যে রনি একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। সে পালিয়ে থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের অন্যতম প্রধান ক্যাডার হিসেবে কাজ করতো।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা তেজগাঁও) শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের ক্যাডাররা ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা শাহাদাতের হয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে। তাদের অন্যান্য সহযোগীকেও গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে।’

গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মাঝখানে কয়েক বছর বৃহত্তর মিরপুর-পল্লবী এলাকায় শাহাদাতের উৎপাত কমে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তার ক্যাডাররা ফের চাঁদাবাজি শুরু করেছে। বিভিন্ন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ নানারকম অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করেছে শাহাদাতের ক্যাডাররা। চাঁদা না দিলেই গুলি করে হত্যার ভয় দেখানো হয়। শাহাদাতের ক্যাডাররা টার্গেট করা ব্যক্তির ব্যবসায়িক ও পারিবারিক সব খোঁজ-খবর নিয়ে ফোন করে চাঁদা দাবি করে। বিশেষ করে কার সন্তান কোন স্কুলে পড়ে সেই খবর জানিয়ে সন্তানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে ব্যবসায়ীরা গোপনে দর কষাকষি করে শাহাদাতের ক্যাডারদের হাতে চাঁদার টাকা তুলে দেয়।

বাবু, শাহিন, রনি, সোহেল ও সাইফুল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুর এলাকার এক ওয়ার্ড কমিশনার এই প্রতিবেদককে জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই শাহাদাত তার কাছে চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা না দেওয়ায় তার ক্যাডাররা ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্ত্রীকে অনুসরণ শুরু করে। স্ত্রী বাসায় এসে কান্নাকাটি করায় ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদাতকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দেয়।

ঢাকা মহানগর উত্তরের এক ছাত্রলীগ নেতা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত তাকে প্রায়ই ফোন করে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। নিজের ক্যাডারদের থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢোকানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। তার ক্যাডাররা প্রায়ই তার আশপাশে মহড়া দেয়। কমিটিতে তার লোক না ঢোকালে তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান ওই ছাত্রলীগ নেতা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের অন্যতম দুই শুটার ছিল মোহসিন ও রনি। সম্প্রতি মোহসিন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এরপর থেকেই রনি আরও বেশি সতর্ক হয়ে চলাফেরা করছিল। তবে গোয়েন্দা অনুসন্ধানের মাধ্যমে চার সহযোগীসহ রনিকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মিরপুরের বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ অন্তত আটটি মামলা রয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও জানান, ২০১৩ সালে চাঁদা না দেওয়ায় সুমন নামে এক ব্যক্তিকে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের নির্দেশে হত্যা করে রনি। এরপর সে পালিয়ে কিছুদিন ভারতে শাহাদাত, মোক্তার, মামুন ও জামিলের সঙ্গে অবস্থান করে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে সে আবার দেশে ফিরে আসে। পুরান ঢাকার বংশালে রনির মামার একটি হোন্ডার দোকান রয়েছে। মামার আশ্রয়ে থেকে ব্যবসায়ী হিসেবে দোকানে বসা শুরু করে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ফের মিরপুরে ফিরে আসে রনি। শাহাদাতের নির্দেশে আরেক সহযোগী মোহসিনসহ শুরু করে চাঁদাবাজি। গত ৩১ জুলাই পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মোহসিন। এর পরপরই রনি মামার বাসা ছেড়ে ডেমরায় শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করে। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জের চুনকুঠিয়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপন করেছিল।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, রনি মূলত শাহাদাতের শুটার ছিল। চাঁদা না পেলে রনি গুলি করে আসতো। তার সঙ্গে তপু, শাহাজাদা, মুন্না, যুবরাজ নামে আরও কয়েকজন শুটারও শাহাদাতের হয়ে কাজ করতো। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া বাবু মিরপুর-১১ নম্বরে ডেসপারেট বাবু হিসেবে পরিচিত। সে মূলত শাহাদাতসহ ভারতে পালিয়ে থাকা মামুন-জামিলের হয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতো। বাবুর সঙ্গে এলাকায় নাটা বিপ্লব, সফিকুল ও ফয়েজ নামে আরও কয়েকজন চাঁদাবাজি করতো। এসব চাঁদার ভাগ ভারতে পাঠানোর পাশাপাশি মিরপুরের লিংকন, আকরাম ও মানিককে দেওয়া হতো। গ্রেফতার হওয়া শাহীন একই সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত ও কাফরুলের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিমের ক্যাডার হিসেবে কাজ করতো। ভাষানটেক এলাকার বিভিন্ন বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি ছাড়াও ব্যবসায়ী ও বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতো সে। এসব কাজে তার সঙ্গী ছিল মুসা ও শামীম। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তারা তিন জন মিলে অস্ত্র দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসতো।

অস্ত্রসহ আটক সন্ত্রসীরা গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া সাইফুল ও সোহেল রানা মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ন্ত্রণসহ অটোরিকশা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতো। এলাকায় তাকে শেল্টার দিতো শাহাদাতের অপর দুই ক্যাডার রূপনগরের বাপ্পী ও আরজু। জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল ও সোহেল জানিয়েছে, প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বাপ্পী ও আরজুর মাধ্যমে সে শাহাদাতের কাছে পাঠিয়ে দিতো।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার হওয়া শাহাদাতের পাঁচ ক্যাডারকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতরা তাদের সহযোগী হিসেবে আরও অনেকের নাম বলেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গ্রেফতার হওয়া ক্যাডাররা মিরপুর এলাকার অনেক রাজনৈতিক পদ-পদবিওয়ালা ব্যক্তিদেরও নাম বলেছে। এসব তথ্যও যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে মিরপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত ফের এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। শাহাদাত নিজে এবং তার ক্যাডাররা ফোন করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে চাঁদা চাইছে। কেউ চাঁদা না দিলে তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আমাকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। আমরা মিরপুরে আর কোনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেবো না।’ তিনি শাহাদাতের সব ক্যাডারকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জোর দাবি জানান।

/টিটি/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি