X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ আমলে নেয় না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

জাকিয়া আহমেদ
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:০০আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৫৩

করোনাভাইরাস

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (৭ সেপ্টেম্বর) করোনায় ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত করোনায় ৪ হাজার ৫১৬ জনের মৃত্যু হলো। এই সময়ে শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ২০২ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্ত হলেন ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৩ জন। দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন গত ৮ মার্চ, জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় মৃত্যুর খবর দেয় তারা। সেই হিসেবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঠিক ছয় মাসের মাথায় মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে চার হাজার ছাড়ালো।

অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে এখন সক্রিয় করোনা রোগী আছেন ৯৮ হাজার ২৭০ জন।

এদিকে, সামনে শীতের মৌসুমে করোনার সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার সচেতনতার দিক থেকে গা-ছাড়া ভাবের কারণে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সংক্রমণের এই সময়ে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়াতে সংক্রমণের হার আরও বাড়বে। আর সেটা ঠেকাতে হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যদিও কার্যকর লকডাউন নিয়ে তাদের মন্তব্য−ট্রেন মিস হয়ে গেছে, তবুও চেষ্টা করতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, সেটা তুলে নেওয়া হয় ৩১ মে। তারপর থেকেই করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। অথচ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, বন্ধ হয়ে যাওয়া বুলেটিন চালু করা, টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো, কার্যকর লকডাউনের মতো অনেক পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা দিলেও সেদিকে নজর নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাঁচতে হলে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা অধিদফতর তাদের কথা শুনছে না।

করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত আয়োজন সংবাদ বুলেটিন বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিস্থিতির উন্নতির কথা বলে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে, তাই প্রতিদিন আর বুলেটিনের দরকার নেই।'

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে দুনিয়ার নানান কিছু পাল্টে দিয়েছে করোনাভাইরাস। বিশ্ব জুড়ে এতে আক্রান্ত বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে গত ১১ মার্চ মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংক্রমণ ঠেকাতে নানা দেশে আরোপ করা হয় কঠোর লকডাউন। তারপরও ঠেকানো যায়নি এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত জাতীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠকেও সিদ্ধান্ত হয়−প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে সংক্রমণ কমানো যাবে। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন জোরদার ও তদারকি করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

রাজধানী ঢাকাতে পাইলট ভিত্তিতে পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারীতে লকডাউন করলেও পরবর্তীতে কোনও পদক্ষেপ নেই। গত জুলাই থেকে লকডাউন কার্যক্রম ঝিমিয়ে আছে এবং এ নিয়ে কোনও ভাবনাও নেই মন্ত্রণালয়ের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'মানুষ সচেতন হচ্ছে, মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মানুষ যদি নিজের সচেতনতা না বোঝে, নিজে বাঁচতে না চায়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কতটুকু করতে পারে?' তিনি বলেন, 'এটা হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্র, কল্যাণ রাষ্ট্রে মানুষকে কতটা আইন ইমপোজ করতে পারি, সেটাও দেখতে হবে।'

টেস্ট বাড়ানোর বিষয়ে আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, কিন্তু সরকার সেটা করছে না, নাকি করতে পারছে না, তা জানি না মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'লকডাউনের কথাও বলেছি। সেটাও সরকার করছে না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একটা ইজি লকডাউন দরকার। মানুষকে পরীক্ষা করে শনাক্ত করে তাদের আইসোলেটেড করতে হবে। যারা পজিটিভ, তাদের আইসোলেটেড এবং যারা তাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টিন। পুরো এলাকা বাঁশ দিয়ে বন্ধ করা, তালা-চাবি দেওয়ার কোনও দরকার নেই। কিন্তু লকডাউনের বিষয়ে সরকারের কোনও নজরই নেই।' একইসঙ্গে সার্ভিলেন্সের জন্য অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা দরকার বলেও মন্তব্য তার।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে পারলে বোঝা যেতো সংক্রমণের হার কোন পর্যায়ে রয়েছে। অথচ সেটাও করা হচ্ছে না, তারা কী করছে, কী করতে যাচ্ছে কিছুই বুঝি না।'

একই কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। বিশেষজ্ঞদের কথা আমলে নেওয়ার আর দরকার নেই, যা অঘটন ঘটার সেটা ঘটেই যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ছিল−বুলেটিন চালু করার, সেটা করা হচ্ছে না, কারণ জনগণকে তারা ভয় পায়। অথচ বুলেটিনে মানুষ সঠিক সরকারি তথ্য পেতো এবং সে অনুযায়ী কিছুটা সচেতন হচ্ছিল। কিন্তু যখন তারা প্রেস রিলিজ দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের সেটা পাওয়ার স্কোপ কম।'

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, 'তারা যেহেতু এটা বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে পিপলস পারসেপশন অনেক কিছুই আসতে পারে, একে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।'

অপরদিকে, অ্যান্টিবডি টেস্ট দরকার ছিল করোনার গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য। কিন্তু লকডাউন কার্যকর করে, যদি অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতো তাহলে 'ইমিউন' কতটুকু হলো, সেটা বোঝা যেতো। একইসঙ্গে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে 'সিম্পটমলেস ইনফেকটেড' কী পরিমাণ মানুষ রয়েছে, সেটা জানা যেতো।

অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডিক্লেয়ার দিয়েছেন, কিন্তু এখনও কোনও প্রজ্ঞাপন হয়নি। মন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে বলা আর সরকারি নির্দেশ জারি করা ভিন্ন বলেও মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজার কমিটির সদস্য এবং কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি টেস্ট এক্সপ্ল্যানশন পলিসি কমিটির কনভেইনার অধ্যাপক লিয়াকত আলী।

তিনি বলেন, 'রাজনীতি যদি বিজ্ঞানের ওপর বেশি ভর করে ফেলে, তাহলে সেখানে পলিসি খুব নেগলেটেড হয়ে যায়, আমাদের দেশে যেন সেটা না হয়। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের পর রাজনৈতিক বিবেচনা, এটাই সিস্টেম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাজনীতি আপারএন্ডে গেলে অনেক দুর্ভোগ থাকে, আর এটা শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, পুরো পৃথিবীতেই কোভিড-১৯ এর রাজনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি জেনারেল ট্রেন্ড হয়ে গেছে, কিছু দেশ বাদ দিয়ে।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার কমিউনিটি এনগেজমেন্টে ফেল করেছে, একইসঙ্গে লকডাউন ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে, সেক্ষেত্রে কীভাবে কমিনিউটিকে সম্পৃক্ত করে কী কী মেজার নেওয়া যায়, সেগুলো করতে হবে। এখন আর অর্ডার দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়, শুরুতে ট্রেন মিস করে ফেলেছি আমরা।'

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি, বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে আর সেটা ভুল করে নয়, সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল পথে হেঁটেছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস। তিনি মনে করেন, মহামারি যখন আসে তখন মহামারি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের নিয়েই মূল কাজ করতে হয়, তাদের আমলে নিয়ে, তাদের মতামত, তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হয়।

চিন্ময় দাস বলেন, 'সংক্রমণ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য চেষ্টা করতে হবে, একথা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকে বারবার বলেছেন। কিন্তু সংক্রমণ কমেছে বা নিয়ন্ত্রণে এসেছে−মন্ত্রণালয়ের একথা ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু না। আর কোনও কারণে যদি নতুন করে 'বার্স্ট আউট' হয়, তাহলে তার জন্য আমাদের 'পে' করতে হবে, তবে আমি জানি না তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে কিনা।

কোভিড নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনিক ক্যাডারদের হাতে ছিল, এভাবে কোনও মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, বিশেষজ্ঞদের মতামত আমলে নিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

/জেএ/এএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!