X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জবাইয়ের পর মাইজভাণ্ডারী সোহেলের লাশ নদীতে ফেলে দেয় জঙ্গিরা

নুরুজ্জামান লাবু
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২৩:১২আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০৭

জবাইয়ের পর মাইজভাণ্ডারী সোহেলের লাশ নদীতে ফেলে দেয় জঙ্গিরা কবিরাজির কথা বলে একটি পরিত্যক্ত ইটভাটায় ডেকে নেওয়া হয় মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানাকে। প্রথমে শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সোহেল শরবত খেতে না চাইলে তার হাত-পা বাঁধা হয়। জঙ্গি নেতা সুমন তাকে নিজ হাতে জবাই করে। জবাইয়ের পুরো দৃশ্য ভিডিও করা হয় মোবাইলে। তারপর সেই লাশ বস্তায় ভরে নৌকায় করে নেওয়া হয় কাপাসিয়া ব্রিজ এলাকায়। নাড়িভুঁড়ি কেটে বের করে পাথর বেঁধে লাশ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ট ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি দল রবিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) গাজীপুরে সোহেলের লাশ উদ্ধারের জন্য অনুসন্ধান চালিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৩১ জুলাই ঈদের আগের রাতে নৃশংস এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএসের অনুসারী বাংলাদেশের নব্য জেএমবির একটি সেল। আইএসের আদলেই জবাইয়ের ভিডিও ধারণ করে তা নিজেদের একাধিক প্রোপাগান্ডা চ্যানেলে প্রচার করে। গত ১৬ আগস্ট আইএস এই হত্যার দায় স্বীকার করে। আইএসের মিডিয়া সেল থেকে নিয়ে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ নিহত সোহেলের একাধিক ছবিও প্রকাশ করেছিল।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৪ জুলাই রাজধানীর পল্টনে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এর সঙ্গে নব্য জেএমবির নতুন একটি গ্রুপের সন্ধান পান তারা। পরে ১১ আগস্ট অভিযান চালিয়ে সিলেট থেকে নব্য জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা পল্টনে বোমা বিস্ফোরণের পাশাপাশি তাদের সদস্যরা নওগাঁয় একটি  মন্দিরে বোমা হামলা ও গাজীপুরে এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে বলে জানায়।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, সিলেট থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা গাজীপুরকেন্দ্রিক সেলটির সদস্যদের শনাক্তের চেষ্টা করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১১ সেপ্টেম্বর উত্তরার আজমপুর থেকে মামুন আল মুজাহিদ ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রহমান, আল আমীন ওরফে আবু জিয়াদ, মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে রোকন ওরফে আবু তারিক ও সারোয়ার রহমান রাহাতকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর চার জঙ্গি পল্টনে বোমা বিস্ফোরণে জড়িত থাকার পাশাপাশি গাজীপুরের মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানাকে জবাই করে হত্যার কথাও স্বীকার করে।

সিটিটিসি উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া চার জঙ্গি পল্টনের বোমা বিস্ফোরণ ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আমরা সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছি।’ আইএসের দায় স্বীকার করা মাইজভাণ্ডারী সোহেল হত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানাকে হত্যার বিষয়েও জঙ্গিরা কিছু তথ্য দিয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত লাশ উদ্ধার হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

গ্রেফতার হওয়া চার জঙ্গি

যেভাবে হত্যা করা হয় মাইজভাণ্ডারী সোহেলকে

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, সিলেট থেকে গ্রেফতার হওয়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নাইমুজ্জামান নব্য জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করছিল। নাইমুজ্জামান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জঙ্গি সদস্য রিক্রুট করে তাদের ‘টার্গেট কিলিং’সহ বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে হামলার নির্দেশনা দিয়েছিল। গাজীপুরের শ্রীপুরের বড়মি বাজার এলাকার মামুন আল মুজাহিদ চলতি বছরের শুরুর দিকে নাইমুজ্জামানের হাত ধরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। এরপর তাকে একটি টার্গেট ফিক্সড করে আইএসের আদলে হত্যার নির্দেশনা দেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন জানান, আল-আমীন, রোকন ও রাহাত তার মাধ্যমেই নব্য জেএমবিতে সম্পৃক্ত হয়। আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখের মধ্যে তাদের কোনও একটি ‘কাজ’ করে দেখানোর দায়িত্ব ছিল। নাইমুজ্জামানের নির্দেশনা মতে তারা টার্গেট ফিক্সড করতে গিয়ে বড়মি বাজারের মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানাকে টার্গেট করে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ (৩১ জুলাই, ২০২০) সন্ধ্যায় তারা বড়মি বাজার থেকে মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানাকে কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে পাশের একটি ইটভাটায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে সোহেল রানাকে আটকে রেখে বিষয়টি সামরিক শাখার প্রধান নাইমুজ্জামানকে জানায়। নাইমুজ্জামান তাকে দ্রুত ‘কাজ’ অর্থাৎ জবাই করে হত্যা করতে বলে।

মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা প্রথমে হত্যার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। এদিকে নির্দেশনা মতো জিলহজ মাসের ১০ তারিখও অতিক্রম হয়ে যাচ্ছিল। রাতে তারা একবার শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে চেয়েছিল সোহেলকে। কিন্তু সোহেল শরবত খেতে না চাওয়ায় তার হাত-পা বেঁধে কিছুক্ষণ ফেলে রাখা হয়। পরে মামুন নিজ হাতে সোহেলকে জবাই করে। পুরো বিষয়টি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিডিও করে নাইমুজ্জামানের কাছে পাঠায়। পরে লাশটির পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে শরীরের সঙ্গে ইট বেঁধে বস্তায় ভরে। সকালে একটি নৌকায় করে কাপাসিয়া ব্রিজের কাছে নদীতে ফেলে দেয়।

সিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা গাজীপুরে একটি টিম পাঠিয়েছি। জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য আমাদের টিম সরেজমিন গিয়ে যাচাই-বাছাই করছে। আমরা লাশটি উদ্ধারের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে যে নৌকার মাধ্যমে লাশের বস্তা নেওয়া হয়েছে সেই মাঝিকেও শনাক্ত করা হয়েছে। লাশ উদ্ধার হলে তাদের বিরুদ্ধে আলাদা একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হবে।’

যা বলছে মাইজভাণ্ডারী সোহেলের পরিবার

এদিকে মাইজভাণ্ডারী সোহেলের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা প্রায় আড়াই মাস ধরে সোহেলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছেন। সোহেলের কী হয়েছে এ বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। যোগাযোগ করা হলে সোহেলের ভাই সাইফুল ইসলাম জুয়েল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানাধীন শিলসি গ্রামে। তার বাবা আবুল কাশেম মাইজভাণ্ডারীর মতাদর্শের অনুসারী। কয়েক বছর আগে তার বড় ভাই সোহেলও মাইজভাণ্ডারীর মুরিদ হন। বছর কয়েক আগে ভাবির সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর তার ভাই সোহেল বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ান আর তাবিজ, সুতা, পাথর ইত্যাদি বিক্রি করেন।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল জানান, তার ভাই গাজীপুরের শ্রীপুরের বড়মি বাজারে থাকতেন। মাঝে মধ্যেই বাড়িতে আসতেন। কোরবানির ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ জুলাই বাবার সঙ্গে তার ভাইয়ের সর্বশেষ কথা হয়। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ। উল্লেখ্য, গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমনও জানিয়েছে, ৩১ জুলাই সন্ধ্যায় তারা মাইজভাণ্ডারী সোহেলকে ইটভাটায় নিয়ে মধ্যরাতে জবাই করে হত্যা করেছেন।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘মাজারে মাজারে ঘোরার কারণে আমরা মোবাইল বন্ধ থাকার কারণে কোনও সন্দেহ করি নাই। এজন্য থানায় জিডিও করি নাই। এখন আমরা জানতে পারছি তাকে হত্যা করা হয়েছে। কীভাবে কি হয়েছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

জঙ্গি সুমনের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা

পল্টনে বোমা বিস্ফোরণ ও মাইজভাণ্ডারী সোহেল হত্যার সঙ্গে জড়িত মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলার সন্ধান পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। চাঁদাবাজি, ডাকাতি, লুটতরাজ ও অস্ত্র মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শ্রীপুরের বড়মি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করে মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন।

সুমনের দাবি, তার বাবা মোসলেম মাস্টার স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় আরেক নেতা রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এসব কারণে হতাশ হয়ে সে ধীরে ধীরে ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহী হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নব্য জেএমবির এক সদস্য তাকে নাইমুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মাইজভাণ্ডারী সোহেলকে হত্যার মাধ্যমে সে সংগঠনে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে। সিলেটে নাইমুজ্জামানের মেসে গিয়ে তার বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই চার সহযোগীসহ নাইমুজ্জামানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সুমনের বিরুদ্ধে ১২টি মামলার সন্ধান পেয়েছি। ঢাকার মিরপুর থানায় একটি অস্ত্র মামলারও আসামি সে। এসব মামলার বিষয়ে সে যেসব বক্তব্য দিয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ