X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মিথিলার চলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়’

জাকিয়া আহমেদ
১৮ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৪২আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৫৫







মিথিলা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় তিনি কাজ করতেন নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে। আর তিনিই মাতৃত্বের স্বাদ নিতে গিয়ে চিকিৎসকদের অবহেলা, ভুল চিকিৎসা আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় প্রাণ হারালেন। তিনি ফারজানা ইসলাম মিথিলা। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে গত ২৯ মার্চ ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
পরিবারের অভিযোগ- ভুল চিকিৎসা, অপারেশনের সময় অবহেলা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সব অপারেশনের সময় অপারেশন নোট এবং অ্যানেস্থেসিয়া নোট থাকে, কিন্তু মিথিলার অপারেশনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই ছিল না। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিথিলার অপারেশনের দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক। এদিকে, মিথিলার মা-বাবা সুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
মিথিলার ভাই মিথেন এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মিথিলার চলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। এটা একটা হত্যাকাণ্ড। পপুলার হাসপাতালের কিছু হলো না, হবেও না। ডা. সুরভীরও কিছু হবে না, তিনি টিম নিয়েই চলবেন সব জায়গায়। আরও মানুষ মারবেন। মাঝখান থেকে আমরা সব হারালাম।
তিনি জানান, মিথিলার দুই ছেলে এখন দাদির কাছে থাকে। বড় ছেলে দিব্য এখনও জানে না তার মা নেই। দিব্য জানে, ছোট ভাইকে তার কাছে দিয়ে মা বেড়াতে গেছে। কদিন বাদেই ফিরে আসবে। ছোট্ট এ ছেলেটি জানে না, মায়ের এ বেড়ানো আর কোনওদিন শেষ হবে না।
মিথেন আরও বলেন, পুরোপুরি চিকিৎসকদের অবহেলা এবং পপুলার হাসপাতালের মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে বোনকে হারিয়েছি। অপারেশন থিয়েটারে আড়াই ঘণ্টা-তিন ঘণ্টা কী হচ্ছে সেটাও তারা আমাদের জানায়নি। ওটি থেকে সরাসরি আইসিইউতে নিয়ে গেছে। অথচ সেখানে মিথিলার হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক হয়েছে। তারা এই পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে গোপন করেছে। তারা মিথিলার প্রেসার কন্ট্রোল না করেই অপারেশন করেছে, অ্যানেস্থেসিস্টের ভুলের কারণে। ডা. সুরভী যেহেতু টিম লিডার, তাই তাকেই এর দায় নিতে হবে।
তবে হতাশা প্রকাশ করে প্রকাশ করে মিথেন বলেন, এখন আর এসব বলে কিছুই হবে না। আমি বোন হারিয়েছি, মেয়েকে হারিয়ে আমার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর দুই বছর বয়সী সন্তান হারিয়েছে তার মা, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তবে এ ধরণের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করা দরকার। যেন আর কেউ তার পরিবারের কাউকে এভাবে নামী হাসপাতালে নেওয়ার পরেও তাকে না হারায়।
তিনি জানান, মিথিলার হাইপার টেনশন ছিল প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই, সেই অনুযায়ী ওষুধও খেত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গাইনি কনসালট্যান্ট ডা. পারভীন আখতার শামসুন নাহার সুরভীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিথিলা।
আরও পড়ুন: স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে

মিথেন জানান, ২৪ মার্চ মিথিলাকে ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বেলা তিনটায় অপারেশন হওয়ার কথা থাকলেও রোগী রেডি করতে বলে ডা. সুরভী অনেক দেরিতে আসেন। এরই মধ্যে মিথিলাকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে ফেলে রাখা হয়। ডাক্তার এলেও থিয়েটার খালি না থাকায় অপারেশন শুরু করতে পারছিলেন না। অপারেশন থিয়েটারে তাকে নেওয়া হয় চারটায়, অপারেশন শুরু হয় বিকাল সাড়ে পাঁচটায়, অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর থেকে অপারেশন শুরু করার সময়টাই অনেক বড় বিষয় ছিল মুত্যুর জন্য, অবহেলাটা শুরু হয় তখন থেকেই। চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা কেন হলো এটাও আমাদের জানানো হয়নি। একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি, এমনকি মিথিলার মৃত্যুর পর ডা. সুরভীও এটা স্বীকার করেছেন আমাদের কাছে।



মিথেন বলেন, আমাদের অভিযোগ ডা. সুরভীর প্রতি এখানেই। আর পপুলারের লোকজন তাদের সহযোগিতা করেছে, না হলে এটা হতে পারে না। আমরা চাচ্ছি সামাজিক সচেতনতা। যেহেতু লিগ্যাল প্রসেস অনেক সময় সাপেক্ষ। মিথিলা কাজ করতো নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে কাজ করা সংগঠন মেরি স্টোপসএ। ২৭/২৮ তারিখের দিকে মেরি স্টোপসের পাঁচ জন চিকিৎসকও যান ওখানে, তারাও মতামত দিয়েছেন- অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।

সন্তান কোলে মিথিলা নিউরোসার্জনরা জানিয়েছেন, ওটিতে স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে যেটা ডা. সুরভী প্রথম থেকেই অস্বীকার করেছেন। ব্রেন ড্যামেজ হয়েছে প্রথম দিনেই। কিন্তু মিথিলাকে ৭ দিনের মতো আইসিইউতে রাখলো তারা। প্রতিদিন তিনি আমাদের আশা দিয়ে গেছেন, নফল নামাজ পড়তে বলেছেন। এগুলো আমাদের জন্য ট্রিমেন্ডার্সভাবে মানসিক পীড়া দিয়ে যাচ্ছে।

অপারেশন থিয়েটারেই প্রথম দিকেই মিথিলার হার্ট ৭ মিনিটের মতো বন্ধ ছিল, কিন্তু এটা যেন টের না পাই আমরা সেজন্য ডা. সুরভী শুধু অভিনয় করে গেছেন পরবর্তী দিনগুলোতে আমাদের সঙ্গে। এগুলোও পপুলার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানে।

আরও পড়ুন: মাহমুদুর রহমান জয়কে অপহরণ চক্রান্তে ‘মাহমুদুর রহমানও ছিলেন’
তিনি বলেন, চিকিৎসকরা বলেছেন, দুই ঘণ্টা আগে মিথিলার যে ব্লাডপ্রেসার মাপা হয়েছিল, সেটার ওপর ভিত্তি করেই তখন সবকিছু করা হয়। আর মিথিলার অপারেশনের সময়ে ডা. সুরভীর টিমমেট ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম (সহযোগী অধ্যাপক, এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার) মিথিলাকে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেন বলে জানতে পেরেছি। তার সেই ওষুধের কারণেই মিথিলার ব্লাড প্রেসার না কমে বরং বেড়ে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। পপুলার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের এসব কিছু দেখাতে পারেনি। পরে ডা. সুরভী বের হয়ে এসে বলেন, মিথিলার অবস্থা ভালো না, তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু আইসিইইতে রোগী ভর্তির সময়ে রোগীর বিস্তারিত জানানোর নিয়ম হলেও হার্ট অ্যাটাক গোপন করে শুধু খিঁচুনি হয়েছে বলা হয়। এমনকি ডা. সুরভী মিথিলার সিটি স্ক্যান করার বিপক্ষে ছিলেন যেন ওটিতে হওয়া হার্ট অ্যাটাকের ব্যাপারে কেউ জানতে না পারে।



মিথেন বলেন, মিথিলার পোস্টপার্টাম অ্যাক্লামশিয়া (খিঁচুনী) হয় ডা. রফিকের ভুল ওষুধের কারণে। জানা গেছে, ডা. সুরভী পপুলার হাসপাতালের নিয়মিত ডাক্তার নন। তিনি চেম্বার করেন গ্রীণ ডেলটা হেলথ কেয়ার, মিরপুর এবং পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মিরপুর এ। আর এ কারণেই ধানমণ্ডি পপুলার শুধু তাকে ওটি ব্যবহার করতে দেয়। আমাদের এক আত্মীয় চিকিৎসক, তাকেও ডা. সুরভী অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে দেননি। টিম ছাড়া কোনও চিকিৎসককেই তিনি ওটিতে ঢুকতে দেন না।

এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. সুরভী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য। মিথিলার পরিবার ভুল কথা বলছে। ডেলিভারির পর পোস্টপার্টাম অ্যাক্লামশিয়া হয়, প্রেসার বেড়ে গিয়ে স্ট্রোক হয়, তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ওখানেই তার মৃত্যু হয়।

তবে মিথিলার অপারেশনের সময়ে দেওয়া অ্যানেস্থেসিয়া নোট ছিল না বলে স্বীকার করেন ডা. সুরভী।

অপরদিকে পপুলার হাসপাতালের পরিচালক ডা. আহমেদ শফিকুল হায়দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডা. সুরভী রোগীর পরিবারের পরিচিত ছিলেন আগে থেকেই, তার ওপর তাদের আস্থাও ছিল। ডা. সুরভী তার টিমের অ্যানেস্থেসিস্ট নিয়ে এই অপারেশন করেন।

মিথিলার মৃত্যুর পর ডা. সুরভী এসব বিষয়ে তাদের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। আমরা ওই দিন যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো- রোগীরা আসতে দেরি করেছেন। আমরা হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানি, তারা যত ধরনের ব্যাখ্যা চেয়েছেন সব ব্যাখ্যার উত্তরই তাদের দেওয়া হয়েছে। ডা. সুরভী তাদের বলেছেন, আমি ধাপে ধাপে সব কাজ করেছি। আপনারা যেসব কথা শুনেছেন তা নয়- আমি তাদের মাঝখানে উপস্থিত থেকে এটুকু শুনেছি।

হাসপাতালের তরফ থেকে কোনও তদন্ত করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে ডা. আহমেদ শফিকুল হায়দার বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যারা ছিলেন তারা কাগজপত্র দেখেছেন, যারা বিশেষজ্ঞ ছিলেন তারাও ডা সুরভীর সঙ্গে একমত হয়েছেন, ওনারা যা দাবি করছেন সে বিষয়ে তারা কোনও প্রমাণ পাননি।

ডা. সুরভী হাসপাতালে আসার আগেই তার টিম মিথিলাকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ভুল কথা।

বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আহমেদ শফিকুল হায়দার আরও বলেন, মিথিলার চিকিৎসার মোট বিল হয়েছিল আইসিইউ, ওষুধসহ ৩ লাখ ২১ হাজার টাকা। পরে মিথিলার বাবা এসে সব কাজগপত্র নিয়ে গেছেন এবং উনি বলেছেন, ওনারা একটু চেক করতে চান। এটা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই, ওনারা যখন আসবেন তখনই বিল নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: কামাল মজুমদার বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে কামাল মজুমদার!

/এজে/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?