একে একে বরখাস্ত হচ্ছেন বিরোধী মতাবলম্বী স্থানীয় সরকার পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। বিরোধী মতের এ সব নির্বাচিত প্রতিনিধির বেশিরভাগই বরখাস্ত হচ্ছেন রাজনৈতিক মামলায় আসামি হওয়ার কারণে। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত কোনও স্তরের জনপ্রতিনিধি বহিষ্কার থেকে বাদ যাচ্ছেন না। নতুন নতুন বরখাস্ত আদেশে প্রতিনিয়তই দীর্ঘ হচ্ছে তালিকা। চলতি এপ্রিল মাসে জামায়াত-সমর্থিত সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিএনপি-সমর্থিত চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও মংলাপোর্ট পৌরসভার মেয়রসহ বিভিন্নস্তরের কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অবশ্য সরকার দাবি করেছে, আইন অনুসরণ করেই বরখাস্ত করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুবছরে সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকার পরিষদের প্রায় আড়াই শত নির্বাচিত প্রতিনিধি সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। যাদের প্রায় সবাই বিএনপি ও তার জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াত-সমর্থিত।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এসব বহিষ্কার আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে মামলার ধরন উল্লেখ না থাকলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশির ভাগই রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি হয়ে বরখাস্ত হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে ভোটকেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ একাধিক মামলা এবং সরকারের বছরপূর্তির সময় বিএনপি-জামায়াতের টানা ৩ মাসের হরতাল-অবরোধকালে সংঘটিত একই ধরনের অপরাধের মামলায় আসামি হয়ে তারা বরখাস্ত হচ্ছেন। অবশ্য এর বাইরে অর্থ আত্মসাৎ বা তথ্য গোপনসহ অন্যান্য কারণেও কোনও কোনও জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনও জনপ্রতিনিধি যেকোনও ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত চার্জশিট আমলে নিলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পর-পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।
আরও পড়তে পারেন: একাকিত্বের কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করছে শিশুরা!
বর্তমানে দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, গাজীপুর ও কুমিল্লায় বিএনপি-সমর্থিত মেয়র রয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল ও কুমিল্লা বাদে অন্য সিটিগুলোর মেয়র সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। বরখাস্ত না হওয়া বিএনপি-সমর্থিত দুই মেয়রের বিরুদ্ধে সরকার-সমর্থিতদের সঙ্গে ‘তালমিলিয়ে’ চলার অভিযোগ খোদ বিএনপির মধ্যেই রয়েছে। অবশ্য, বরিশালের মেয়র আহসান হাবিব কামালের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতি মামলার তদন্ত চলছে। যেকোনও সময়ে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
গত ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪৮৭টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত দুইশোর মতো চেয়ারম্যান ও ২২৫ জনের মতো ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রায় সমান সংখ্যক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন। উপজেলা পরিষদে জয়ী হওয়ার পর থেকেই মামলায় অভিযুক্তসহ একাধিক কারণে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রায় ধারাবাহিকভাবেই বহিষ্কার হয়ে আসছেন। এমনকি গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-সমর্থিত একাধিক পৌরমেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বরখাস্ত হয়েছেন। বরখাস্ত হওয়া এসব জনপ্রতিনিধির কারও কারও পক্ষে উচ্চ আদালত আদেশ দিলেও বিভিন্ন জটিলতায় পদে বসতে পারছেন না তারা। এক্ষেত্রে কোনও একটি মামলায় রেহাই পেলেও সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন অন্য মামলা।
এদিকে, নির্বাচনে জিতেও বরখাস্ত আতঙ্কে বিএনপি জামায়াতের অনেকে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে জানা গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির দুজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারি দলের চাপের কারণে বিভিন্ন স্থানে তাদের মনোনীত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি, এটা যেমন সত্য, তেমনি কোনও-কোনও জায়গায় পরিবেশ সহায়ক থাকলেও তারা প্রার্থী খুঁজে পাননি। এর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচিত হওয়ার পর বরখাস্ত হওয়ার আতঙ্ক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই দুই নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তাদের দলের সিটি ও পৌরমেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের বেশিরভাগই কোনও না কোনও কারণে বরখাস্ত হচ্ছেন। ইউপিতেও নির্বাচিত হয়ে একই ধরনের ভাগ্যবরণ করতে হবে—এমন আশঙ্কায় নির্বাচন থেকে তারা দূরে থাকছেন।
ঢালাও এসব বরখাস্তের বিরুদ্ধে খোদ সরকারি দল থেকেও বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ উঠেছে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম গত বছরের শেষ দিকে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এসব বরখাস্ত আদেশের সমালোচনা করে বলেন, বর্তমানে দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যদি সরকারি দলের না হন, তবে তাদের মামলা-মোকদ্দমায় ঢুকিয়ে ঢালাওভাবে বরখাস্ত করা হয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও তাদের মামলা দিয়ে বরখাস্ত করা হয়। বিশেষ করে বিএনপি, জাপা এবং আমাদের মতো বিদ্রোহী প্রর্থীদের। এভাবে যদি বরখাস্ত করা হয়, তাহলে নির্বাচিত হয়ে লাভ কী?
জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকার সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণেদিতভাবে বিরোধী মতের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছে। সরকার গণতন্ত্র ও ভোটের রাজনীতিদে বিশ্বাস করে না বলেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একে একে বরখাস্ত করছে। সরকারের এই আচরণ স্বৈরতান্ত্রিক ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রায়নবিরোধী।
আরও পড়তে পারেন: খালেদা জিয়ার মামলার পরবর্তী শুনানি ২৫ এপ্রিল
গত দুই বছরে বিএনপির দুই শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত আমাদের প্রায় সব কয়জন মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি মেয়র আব্দুল মান্নানের উদাহরণ দিয়ে দলের এই নেতা বলেন, উচ্চ আদালতে পদ ফেরত পেলেও তিনি যেন পদে বসতে না পারেন, সে জন্য তাকে নতুন মামলা দিয়ে আবারও গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হনিফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বরখাস্তের অভিযোগ অস্বীকার করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে না। বিএনপি জামায়াতের যেসব জনপ্রতিনিধি জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যাসহ নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেনস এবং এসব ঘটনায় মদদ দিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলায় চার্জশিট হওয়ার পরে তারা বরখাস্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার আইনের বাইরে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কী কারণে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা বরখাস্ত হবেন, সেটা আইনে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। যদি স্থানীয় সরকারের কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলার চার্জশিট হয় এবং মামলায় আসামি হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন, তাহলেই তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হবে। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে যদি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাকে বহিষ্কার করা হয়ে থাকে। এ হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, আইন অনুযায়ী তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা যদি আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে পদ ফিরে পাবেন।
/এমএনএইচ/