X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রথম মাদ্রাসা কোনটি?

বেলায়েত হুসাইন
৩০ মার্চ ২০২৩, ২৩:৫৯আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৫০

বাংলাদেশে দুটি ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে—আলিয়া ও কওমি। উভয়টির সূচনাই অবিভক্ত ভারতবর্ষে। প্রথম আলিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস, ১৭৮০ সালে। যেটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিত। আর বর্তমানে প্রচলিত কওমি মাদ্রাসার গোড়াপত্তন দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিললো বেশ কিছু তথ্য। বলা চলে– ওইসব তথ্যের একটি আরেকটির বিপরীত। জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ (লালবাগ মাদ্রাসা) থেকে ‘আলোর কাফেলা’ নামে ১৯৯৭ সালে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ওই গ্রন্থের বর্ণনা–‘দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের কোন স্থানে বা কোন সালে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, নিশ্চিতভাবে সে কথা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়ে থাকে–সিলেট জেলার ঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসা বাংলাদেশে দেওবন্দের অনুকরণে সর্বপ্রথম মাদ্রাসা।’ সিলেট জেলার ঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসা

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার মুকিগঞ্জ বাজার এলাকায় অবস্থিত ঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসায় যোগাযোগ করলে এর প্রিন্সিপাল মাওলানা মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, এটা কওমি মাদ্রাসা নয়; বরং আলিয়া। নাম ঝিংগাবাড়ি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা। এটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭৪ সাল। 

তবে শুরুতেই এটি পূর্ণাঙ্গ আলিয়া ছিল না বলেও জানালেন প্রিন্সিপাল হাফিজুর রহমান। তার তথ্যমতে—প্রথমে মক্তব শিক্ষা দিয়ে এর গোড়াপত্তন করেন মৌলভি হাবিবুল্লাহ (রহ.)। তিনি ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এখানে এসে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯০৭ সালে তার দুই ছেলে আব্দুল বারি ও ইবরাহিম আলি মাদ্রাসাটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন এর মুতাওয়াল্লি ছিলেন মৌলভি আব্দুর রহিম চৌধুরি। এই সময়ে মাদ্রাসার নামডাক আশপাশের এলাকাগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৭ সালে ফাজিল (ডিগ্রি সমমান) স্তর চালু করা হয়।

মাওলানা মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান আরও জানান, ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাটির এখন যেখানে অবস্থান সেটি মৌলভি হাবিবুল্লাহ (রহ.)-এর হাতে গোড়াপত্তন হয়নি। তার হাতে অঙ্কুরিত প্রতিষ্ঠানটি নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে বর্তমান জায়গায় মাদ্রাসার অবকাঠামো স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু নদীভাঙনে বিলীন হওয়া প্রাচীন অবকাঠামোগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনও সেখানে কিছু অবশিষ্ট রয়েছে।

দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি—ঝিংগাবাড়িতেও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। লালবাগ মাদ্রাসার স্মারকগ্রন্থের বর্ণনায় আরও পাওয়া যায়—‘তবে পরবর্তীতে ১৯০১ সালে, চট্টগ্রামে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অদ্যাবধি এই মাদ্রাসা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত আছে।’ বর্ণনার সূত্র ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও গবেষক আলেম মাওলানা আশরাফ আলি নিজামপুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি–কওমি মাদ্রাসা মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে হাটহাজারীর মাধ্যমে ১৯০১ সালে। কিন্তু ঝিংগাবাড়ি যদি প্রথম হয়ও, তবে সেটা অনানুষ্ঠানিকভাবে হতে পারে।’ তবে এ দেশে কওমি মাদ্রাসার আগে আলিয়া মাদ্রাসার শুরু—বলেন মাওলানা আশরাফ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলহাইয়াতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়্যাহর স্থায়ী কমিটির সদস্য মুফতি মোহাম্মদ আলি বলেন, ঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসার সূচনা হয়েছিল যেহেতু মক্তব শিক্ষা দিয়ে, সময়টি বিবেচনা করেই হয়তো ওটাকে দেশের দেওবন্দী ধারার প্রথম কওমি মাদ্রাসা বলা হচ্ছে।

মুফতি মোহাম্মদ আলি আরও জানান, ‘ঝিংগাবাড়ির ওই মাদ্রাসাটি কওমি থাকা খুবই সম্ভব। কারণ, এখনও দেশের বেশ কিছু আলিয়া মাদ্রাসা আছে, যেগুলোর সূচনা হয়েছিল কওমি মাদ্রাসা হিসেবে। পরে সেগুলো আলিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। আর আলিয়ার বর্তমান যে শিক্ষাকাঠামো—একসময় তা এমন ছিল না; বরং কওমির খুব কাছাকাছি ছিল।’ তার কথায় বোঝা যায়–এজন্য সেসময় কওমি থেকে আলিয়ায় রূপান্তরিত হওয়া খুব শক্ত ব্যাপার ছিল না হয়তো।

এ ব্যাপারে সিলেটে বসবাসরত মাওলানা আতাউল হক জালালাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানান, সেখানকার প্রসিদ্ধ কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হজরত শাহজালাল (রহ.) বা সিলেট দরগাহ মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক ও বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মরহুম ওবায়দুল হক (রহ.)-এর ছেলে তিনি।

হাটহাজারী মাদ্রাসা এ বিষয়ে শুরুতেই ‘ঝিংগাবাড়ি দেশের প্রথম আলিয়া মাদ্রাসা’—প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপালের বক্তব্য খণ্ডন করে তিনি বলেন, ঝিংগাবাড়ির আগে ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিলেটেরই ফুলবাড়িয়া আলিয়া মাদ্রাসা এবং জেলার হেমু মাদ্রাসাও দেওবন্দের আগে থেকে শুরু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই কওমি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। পরে ধীরে ধীরে সরকারি (আলিয়া) হয়েছে।

কিন্তু প্রতিষ্ঠাকাল হিসাবে ফুলবাড়িয়া হেমু মাদ্রাসা দেওবন্দ মাদ্রাসার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর দেওবন্দ হলো কওমি মাদ্রাসার সূচনা, তাহলে ফুলবাড়িয়া ও হেমুর মতো যেসব মাদ্রাসা দেওবন্দের আগে হলো, সেগুলো কীভাবে কওমি? এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা জালালাবাদী বলেন, ‘কওমের সহযোগিতায় চলে–এজন্য কওমি। তাছাড়া, এসব মাদ্রাসাকে (দেওবন্দের আগে প্রতিষ্ঠিত) কওমি বলার মূল কারণ হলো– সেগুলো আকাবিরে দেওবন্দের অনুসরণে পরিচালিত হতো। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হলেন মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)। তিনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার আগ থেকেই সিলেটে তার অনেক ভক্ত-অনুরক্ত ছিলেন। যারা মূলত শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তাধারা লালন করতেন।’ আর দেওবন্দ মাদ্রাসাও যেহেতু শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তাধারায় প্রভাবিত, এজন্য সেগুলোকেও ‘কওমি’ বলাই যায়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।

/এসটিএস/এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন