আমাদের দেশে বাংলা সনের সঙ্গে ইংরেজি (ঈসায়ী) ও হিজরি সনের প্রচলন রয়েছে। ইংরেজি সনের সম্পর্ক সূর্যের সঙ্গে আর হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। আরবদের থেকে হিজরি সনের প্রবর্তন শুরু হলেও এর সঙ্গে মুসলমানদের রয়েছে নিবিড় বন্ধন। কারণ, ইসলামের অনেক ইবাদত হিজরি সন অনুযায়ী পরিপালন করতে হয়। যেমন– হজের মৌসুম, রোজা ও দুই ঈদের তারিখ নির্ধারণ ও জাকাতের বছর গণনা ইত্যাদি। সুতরাং মুসলমানদের কাছে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। ফকিহদের মতে– হিজরি সনের হিসাব রাখা মুসলমানদের জন্য ফরজে কেফায়া। মানে অন্তত কিছু মুসলমানকে অবশ্যই চান্দ্র বর্ষের হিসাব রাখতে হবে।
হিজরি সন কীভাবে এলো?
চান্দ্র বর্ষের সঙ্গে মুসলমানদের ইবাদতের এত নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও ইসলামের প্রাথমিক যুগে হিজরি সনের গণনার অস্তিত্ব ছিল না। বরং তখন চাঁদের হিসাবে উপরোল্লিখিত ইবাদতগুলোর দিনক্ষণ নির্ধারিত হতো বটে, তবে তা চান্দ্র মাস হিসাবে, নিয়মতান্ত্রিক হিজরি ক্যালেন্ডার হিসাবে নয়। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে, কার্যত হিজরি সন গণনা শুরু হয় হিজরতের ১৭তম বর্ষে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তা হলো– হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে একটি চিঠি লিখেন যে আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সন গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সনের গোড়াপত্তন করেন।
হিজরত থেকেই কেন হিজরি বর্ষের সূচনা?
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন হজরত ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি একটি পরামর্শ সভার আহ্বান করেন। সভায় নবীজি (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, নবুয়ত ও হিজরত—বিশেষত এই চারটি সময় থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব আসে। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের বছর, তালহা (রা.) নবুয়তের বছর এবং হজরত আলী (রা.) হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের সন নিয়ে মতানৈক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই শেষ পর্যন্ত সবাই হজরত আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন। মানে— বর্ষ গণনা শুরুর ক্ষেত্রে হিজরতকে প্রাধান্য দেন। এভাবেই হিজরত থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়।
হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম কেন?
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ইসলামী যুগের শুরুর দিকে চান্দ্র বর্ষের নিয়মতান্ত্রিক সন গণনা না থাকলেও ১২ মাসের হিসাব ছিল ঠিকই। পবিত্র কোরআনেও বিষয়টি বর্ণিত আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় ১২টি মাস আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ৩৬) সেই হিসাবে মহানবী (সা.)-এর হিজরত সম্পন্ন হয়েছিল ১২ রবিউল আউয়ালে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তাহলে হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম কেন?
হিজরি সন প্রবর্তনের ওই সভায় ‘হিজরি সনের প্রথম মাস হবে কোনটি?’- এ বিষয়েও একাধিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। হজরত তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি উম্মতের মাস আর হজরত আলী (রা.) ও ওসমান (রা.) মুহাররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন এবং তাদেরটিই গৃহীত হয়।
প্রসিদ্ধ একটি মত অনুসারে, হজরত আলী (রা.) ও ওসমান (রা.)-এর মতটি গৃহীত হওয়ার কারণ হলো- মুহাররম হচ্ছে হজের পরে প্রথম মাস। এ মাসে আরবরা নতুন নতুন কাজ শুরু করতো এবং সমকালীন আরবে মুহাররম ছিল প্রথম মাস।
এক্ষেত্রে আরেকটি মত হলো- মক্কায় যখন মুশরিকরা মুসলমানদের ওপর সীমাতিরিক্ত নির্যাতন করছিল, তখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আদেশে সর্বপ্রথম যে দলটি আবিসিনিয়ায় হিজরত করে- তখন ছিল মুহাররম মাস। এজন্য হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম।
মুসলমানদের কাছে সৌর বর্ষের গুরুত্ব কতটুক?
ইসলামের অনেক ইবাদত পরিপালনে যেমন চাঁদের ওপর নির্ভর করতে হয়, ঠিক তেমনি বেশকিছু ইবাদতের সঙ্গে সূর্যের সম্পর্কও গভীরভাবে বিদ্যমান। যদিও হজ, ঈদ ও রোজা ইত্যাদি শুরু-শেষের সম্পর্ক সৌর বর্ষের সঙ্গে নেই কিন্তু প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় নির্ধারণ, রোজার সময়ের পরিব্যাপ্তি ইত্যাদি সূর্যের হিসাবেই করা হয়ে থাকে। সুতরাং একথা বলার সুযোগ নেই যে– হিজরি বর্ষ মুসলমানদের আর সৌর (ইংরেজি) বর্ষ অমুসলিমদের। কারণ, চন্দ্র ও সূর্য উভয়টি আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’টির আবর্তনও তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে–‘তিনিই সূর্যকে দীপ্তিময় ও চাঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫)
(আলজাজিরা আরবি এবং একাধিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ অবলম্বনে)
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা
আরও পড়ুন: