আওয়ামী লীগের ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। সম্মেলনের পর থেকে গত প্রায় দেড় বছরে থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে উদ্যোগ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি। জুনের শুরুর দিকে প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম জমা দেওয়ার পর পদ নিয়ে রীতিমতো টানাটানি চলছে। এ কমিটিতে পদ পাওয়া ও পদপ্রত্যাশী নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তুলে পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশরা দেওয়ার পরও উভয় শ্রেণির নেতার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই মহানগরের থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটিতে যারা পদ পেতে যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ তুলছেন বঞ্চিতরা। আবার পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে অনিয়মে জড়িত থাকা এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সামনে আনছেন পদ পেতে যাওয়া নেতারা। এর নেপথ্যে রয়েছে মহানগরের বর্তমান কমিটি ও সাবেক কমিটি এবং এমপিদের নিজ নিজ অনুসারীদের পদায়নের চেষ্টা। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যাপক সরব থাকলেও নেতারা প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন।
নগর নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে নেতারা যত সরব, তার চেয়েও বেশি নীরব দেখা গেছে এবার কোটা আন্দোলনের সময় তাদের অনেককে। এখন কমিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মাঠে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ভূমিকার বিষয়টি। প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলছেন পদপ্রত্যাশী অন্যরা আবার পদপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধেও একইভাবে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করছেন কমিটিতে থাকা নেতারা। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে এরইমধ্যে তিন থানা এবং ৮টি ওয়ার্ডের অন্তর্গত আওয়ামী লীগের ২৭ ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অন্যান্য থানা ও ওয়ার্ডের নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন শাখার সম্মেলন হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। সে সময় নতুন কমিটি ঘোষণা না করায় দীর্ঘদিন ধরে মুখ থুবড়ে আছে এসব শাখার সাংগঠনিক কার্যক্রম। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কমিটি দেওয়ার জন্য বারবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বাস্তবায়িত হয়নি ঢাকা মহানগরে। সবশেষ গত ৪ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ২৬টি থানা ও ৬৪টি ওয়ার্ডের এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২৪টি থানা ও ৭৫টি ওয়ার্ডের কমিটি কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে প্রস্তাবিত কমিটিগুলো জমা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। তিনি প্রস্তাবিত কমিটিগুলো অনুমোদনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন। এসব কমিটি শিগগিরই অনুমোদন দেওয়ার প্রত্যাশার কথা শোনা গেলেও কবে নাগাদ সেটি আলোর মুখ দেখবে, তা কেউই বলতে পারছেন না।
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বর্তমান শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন আগের কমিটিগুলোর শীর্ষ নেতারা এবং ঢাকার কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাদের পছন্দের নেতারা প্রস্তাবিত কমিটিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ না পাওয়ায় লিখিত অভিযোগের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সে কারণে এবার প্রস্তাবিত কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগের হিড়িক পড়েছে।
তারা আরও জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগরের উভয় কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে থানা ও ওয়ার্ড কমিটির পদবঞ্চিত নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে নানা অভিযোগ তুলছেন। মূলত, প্রস্তাবিত থানা ও ওয়ার্ড কমিটির বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে পদ না পাওয়া নেতারা অর্থ লেনদেনের বিষয়টি সামনে এনে অভিযোগ পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছেন। আবার এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ পাওয়া নেতারাও নিজেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খণ্ডনসহ পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন। পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মূলে রয়েছে পদ পাওয়া বা না পাওয়া। ফলে পদ নিয়ে টানাটানির কারণে থলের বিড়াল যেমন বেরিয়ে আসছে, তেমনই কাদা ছোড়াছুড়িও চলছে সমান তালে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটির নেতাদের নাম জমা দেওয়ার মাসখানেক অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে পদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে দলীয় প্রধান ও সাধারণ সম্পাদকের বরাবর শতাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। আবার পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধেও দায়িত্বশীল নেতাদের কাছে নানা অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন পদ পাওয়া নেতারা। মূলত, কমিটিতে নাম প্রস্তাব করার পর পদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে পদবঞ্চিতরা আর পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে পদ পাওয়ারা অভিযোগ তুলছেন। সেটি মাথায় রেখে অভিযোগ যাচাই করে কমিটি দেওয়া হবে। তাতে কারও নাম বাদ যেতে পারে, আবার নতুন কারও কারও নাম যুক্ত হতে পারে। সে কারণে উভয়পক্ষের নেতারা কমিটিতে পদ পেতে রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নেত্রীর দফতরে অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেই অভিযোগগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করতেছি। যাচাই-বাছাই শেষে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত এটুকুই বলবো।’
মহানগরের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, প্রস্তাবিত কমিটি গঠন নিয়ে ওঠা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ঢালাও হলেও কিছুটা সত্য। আবার নানা ধরনের অপরাধসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগেরও প্রমাণ রয়েছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন কমিটি আটকে থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সম্মেলনের পরপর কমিটি দিয়ে দিলে হয়তো এমন অবস্থা এড়ানো যেতো। তা ছাড়া প্রস্তাবিত কমিটি কবে নাগাদ ঘোষণা করা হবে, তাও কেউ জানে না। সময় যত বাড়বে পদ নিয়ে টানাটানি এবং কাদা ছোড়াছুড়িও বাড়তে থাকবে।
পদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রস্তাবিত কমিটির বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে পদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে দলীয় প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর জমা পড়া অনেক চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেনদেনের পরিমাণও উল্লেখ করেছেন অনেকে, আবার বিপুল অর্থ লেনদেনের ঢালাও অভিযোগও করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা, দখলদারিত্ব, হত্যা মামলার আসামিসহ নানা কারণে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও এসেছে।
যেমন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের রমনা থানা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে নাম এসেছে গোলাম মোস্তফা শিমুলের। তার বিরুদ্ধে ২০১০ সালে যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যা মামলার আসামি এবং ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। আবার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটিতে সভাপতির পদ পাওয়া ইয়ার উদ্দিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হত্যা মামলার আসামি এবং মাদক ব্যবসার অভিযোগ করেছেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমেদ। মহানগরের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে পদ দেওয়ার অভিযোগ তার। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির বিদায়ী সভাপতি গিয়াস উদ্দিন গেসুর অভিযোগ—২০ লাখ টাকা নিয়েও তাকে পদ দেওয়া হয়নি। টাকা ফেরত চেয়েছেন তিনি। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা সবাই অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ঢাকা-১৮ আসনের উত্তরখান, তুরাগ, বিমানবন্দর, উত্তরা উত্তর-পশ্চিম থানার ১১ নেতা একসঙ্গে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাতে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে অযোগ্য, বিতর্কিত ও বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীদের পদ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত একটি অডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় পদ পেতে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলতে শোনা যায় দক্ষিণখান থানার ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড নেতা আকবর আলীকে। পরে টাকার বিষয়টি ফোনে না বলে সরাসরি বলার পরামর্শ দিতে শোনায় যায় বজলুর রহমানকে।
তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের দাবি, তাদের জড়িয়ে প্রস্তাবিত কমিটিতে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পদ পাইয়ে দেওয়ার পদবঞ্চিতদের করা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা পদ না পাওয়ায় ঢালাওভাবে অভিযোগ তুলে কমিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। আবার পদ পাওয়া নেতারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সামনে এনে নিজেদের নির্ভার করতে চাইছেন। তবে আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে এবং ৫০টি থানা ও ১৩৯টি ওয়ার্ডের কমিটি একসঙ্গে দিতে গিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত কারও কারও নাম প্রস্তাব করা হতে পারে, সেটি অস্বীকার করা যায় না।
‘প্রস্তাবিত কমিটিতে অর্থের বিনিময়ে পদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং ঢালাওভাবে করা’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি, যতটা যত্নবান হয়ে ভালো কমিটি করা যায়। তারপরও কমিটি নিয়ে অনেকে অনুমাননির্ভর অভিযোগ করছেন। এখন কমিটি ঘোষণা করা হলে তখন অভিযোগগুলোর সত্যতা আছে কিনা, সেটি বোঝা যাবে।’
শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘নেত্রী হয়তো শিগগিরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশনা দিয়ে দেবেন। তারপরও কিছু অভিযোগ থাকলে আমরাও বলে দিয়েছি, দলের সাধারণ সম্পাদকও বলে দিয়েছেন— প্রস্তাবিত কমিটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তি থাকলে ঘোষণা করার আগে আমাদের ডেকে বলতে পারেন, এই নামটা কেন দিলা বা এই নামটা বাদ দিলা কেন? তিনি (ওবায়দুল কাদের) নাম পরিবর্তনও করতে পারেন। তিনি বলতে পারেন, এটা বাদ দাও, এটা দিয়ে দাও। কয়দিন আগেও আমাকে দলের সাধারণ সম্পাদক দুটি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি তার জবাব দিয়েছি।’
ভাইরাল অডিওতে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অডিওটি এডিট করা, সেটি গোয়েন্দাদের তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে।’ ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের পদে থাকা এক নেতা তার বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী বলেন, ‘আমরা ভালো কমিটি করার চেষ্টা করেছি। এখানে অর্থের বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। এমনকি অনেকে টাকা নিয়ে এসেছিল, আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন তারা কমিটিতে আসতে না পেরে নানা অভিযোগ করছে।’
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে তার মোবাইলে কল করা হয়। তিনি বিস্তারিত শোনার পর মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে মোবাইলে কথা বলবো না। আসেন, সামনাসামনি কথা বলবো।’
পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ
প্রস্তাবিত থানা ও ওয়ার্ড কমিটির বিষয়টি জানাজানির পর পদ পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন পদবঞ্চিতরা। এর বিপরীতে পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলছেন পদ পাওয়া নেতারা। বিশেষ করে অভিযোগকারী পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মামলায় আসামি হওয়া, বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সামনে আনা হচ্ছে। মূলত, পদবঞ্চিতরা যাতে অভিযোগ করে সুবিধা করতে না পারেন, সেজন্যই এই কৌশল নিচ্ছেন পদ পাওয়া নেতারা।
মহানগরের নেতারা বলছেন, বিদায়ী কমিটির নেতারা পদ না পেয়ে পদ পাওয়াদের আটকাতে প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে নানা অভিযোগ করছেন। এই কমিটি যাতে বিতর্কিত হয়ে না পড়ে, বা নিজেকে রক্ষা করতে উভয়পক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর। কমিটি ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে পারে, কমিটি দেওয়া হলেও বঞ্চিতরা আরও অ্যাগ্রেসিভ হতে পারে। তবে দলীয় সভাপতির অনুমোদিত কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে খুব বেশি প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
যেমন অর্থের লেনদেনে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ করা শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে সরব একই থানার বিদায়ী সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গুলি ছোড়া, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগ তোলা হচ্ছে শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের বিদায়ী সভাপতি জিএম আতিকুর রহমান, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক মো. সারোয়ার, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধেও। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো পদ পাওয়া এক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন আবদুল হামিদ ও মোশাররফ হোসেন। অন্যদেরও বক্তব্য প্রায় একই রকম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতিরা বলছেন, পদপ্রত্যাশী অনেকে। প্রস্তাবিত কমিটি দেওয়ার পর একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। অতীতেও কমিটি দেওয়ার সময় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। তবে এবার অভিযোগ বেশি তোলা হচ্ছে।
নেপথ্যে নিজের লোককে পদায়ন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের এক একটা ওয়ার্ডে সভাপতি পদে ১৫-২০ জন এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ১০-১৫ জন করে পদ প্রত্যাশী রয়েছেন। থানা কমিটির ক্ষেত্রে উভয় পদপ্রত্যাশীর সংখ্যা আরও বেশি। নগর নেতারা বলছেন, এত পদপ্রত্যাশীর মধ্য থেকে দুই পদে দুই জনকে বাছাই করা খুবই কঠিন। ফলে বাদ পড়া অনেকে অনুমাননির্ভর অভিযোগ করছে, ওরে কেন রাখলো বা আমাকে কেন বাদ দিলো!
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ বজলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও কাউন্সিলরকে পদে না বসানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক কাউন্সিলর ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে চান। তারা এলাকায় মানুষের সেবা করেন। দলের পদ পেলে দলকেও সময় দিতে হবে। একজনের পক্ষে দুই জায়গায় সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। সবাই লাভের পেছনে ছোটেন, তাতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরের আগের কমিটিগুলোর নেতারা এবং স্থানীয় অনেক সংসদ সদস্য কলকাঠি নাড়ায় এবার অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ বেশি হচ্ছে। সবার আবদার, আমার লোককে রাখেন। আমরা বলেছি, এমপি বা কোনও নেতাকে দেখে কমিটি করিনি। রাজপথের ত্যাগী নেতা দেখে কমিটি করেছি। দলের বিভিন্ন সংগঠন করা তরুণদেরও আমরা নেতৃত্বে আনতে চাই। তারা যাতে নগর আওয়ামী লীগ এগিয়ে নিতে পারে।
অভিযোগ করার পেছনে কেউ না কেউ কাজ করার কথা বললেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চান না আবু আহমেদ মন্নাফী।
কবে নাগাদ প্রস্তাবিত কমিটি অনুমোদন পাবে বা ঘোষণা করা হবে, সেটি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করছে। সে কারণে এ ব্যাপারে কেউ কিছুই বলতে পারছেন না। তবে চলতি মাসে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ডগুলো নতুন কমিটি পেতে পারে বলে ধারণা করছেন নেতারা। এমন প্রেক্ষাপটে গত ২৫ জুলাই তিন থানা এবং ৮টি ওয়ার্ডের অন্তর্গত আওয়ামী লীগের ২৭ ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সব কমিটি পুনর্গঠন করার বিষয়টিও সামনে আসছে।
মাঠে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা ও সায়েন্সল্যাবে ব্যাপক আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মিরপুর, বাড্ডা, শাহবাগ ও পুরান ঢাকায়সহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। এই আন্দোলন মোকাবিলায় দলীয়ভাবে নেতাকর্মীদের মাঠে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্র বলছে, নির্দেশনা সত্ত্বেও বাস্তবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া এলাকাগুলোতে নিষ্ক্রিয় ছিল দলটির নেতারা, অন্যান্য এলাকায়ও সেভাবে মাঠে সক্রিয় দেখা যায়নি অনেক নেতাকে। প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ পাওয়া কিংবা পদপ্রত্যাশী নেতাদের সিংহভাগই মাঠে ছিল না।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একাধিক বৈঠক ও সভায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোটা আন্দোলনের সময় নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। এ নিয়ে দলীয় ফোরামে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগও তুলতে দেখা গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে। অবশ্য মোহাম্মদপুরের আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অন্যান্য এলাকায় এখনও তা হয়নি।
গত ২৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাতে মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানা ও সেখানকার বিভিন্ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাদের মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে ঢাকা-১৩ আসনের (মোহাম্মদপুর, বসিলা) তিন থানা এবং আট ওয়ার্ডের অন্তর্গত আওয়ামী লীগের ২৭ ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক আন্দোলন মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে ঢাকা-১৩ আসনের আওতাধীন তিন থানা ও আট ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ২৭ ইউনিট কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া ২৭টি ইউনিট কমিটি গঠনের জন্য সেপ্টেম্বর থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওই তিন থানা ও আট ওয়ার্ডসহ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সব থানা ও ওয়ার্ডের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের প্রস্তাবিত নাম গত জুনে জমা দেওয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
ব্যর্থতার দায়ে ঢাকা-১৩ আসনের আ.লীগের ২৭ কমিটি বাতিল