গত ১৬ বছর যুক্তরাজ্যে থেকে কী করছেন তারেক রহমান, কীভাবে চালাচ্ছেন বিএনপি, দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাইরেও সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল এসব নিয়ে। সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর তার সাক্ষাৎ পেতে লন্ডনে আসার জন্য চেষ্টা করছেন। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা নেতারা তার গুডবুকে থাকতে নিচ্ছেন নানা কৌশল। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যারা বহিষ্কৃত, তা প্রত্যাহারের জন্যও জমা পড়েছে আবেদনের স্তূপ।
এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের সাম্প্রতিক ব্যস্ততা, রাজনৈতিক কৌশল ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শনিবার কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, লন্ডনের কিংসস্টন এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বসবাস করছেন তারেক রহমান। বাড়ির পাশে কিংসস্টন লজ নামে একটি হোটেলের লবিতে দেশের ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অতীতে সাক্ষাৎ দিলেও, হোটেলটি ভেঙে ফেলার পর গত কয়েক বছরে সাক্ষাৎ করা কমিয়ে দিয়েছেন তিনি।
দেশে সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাভাবিকভাবেই তারেক রহমানের ব্যস্ততা বেড়েছে। অনেক নেতা ঢাকা থেকে তার সাক্ষাৎ পেতে লন্ডনে আসার জন্য যোগাযোগ করছেন। কিন্তু তার পক্ষ থেকে দলের নেতাদের জরুরি প্রয়োজনে অনলাইনে যোগাযোগে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
নেতাকর্মীদের আরও জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশ
সূত্রগুলো জানায়, তারেক রহমানের এখন বেশির ভাগ সময় কাটে দেশের দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগে। দলের কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা ছাড়াও ৬৪ জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পর্ক রয়েছে তার। দলীয় কর্মসূচি, জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাদের ভূমিকা সরাসরি মনিটর করছেন লন্ডন থেকেই। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কলে সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন নিয়মিত।
আগামী নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে, সেটি সামনে রেখে নেতাকর্মীদের আরও জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন তারেক। দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত নেতারা ত্যাগী, তবু দল ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবে না, এ বার্তা দিতে চাইছেন তিনি।
বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের নানামুখী তৎপরতার মুখে ১৫ বছরের বেশি সময় দল ক্ষমতার বাইরে। এরপরও বিদেশে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারাই তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তারেক রহমান বিদেশে থেকে দল চালাচ্ছেন, অথচ গত সরকারের আমলে সরকারি নানা প্রলোভন ও গোয়েন্দা সংস্থার নানা তৎপরতার মুখেও দলের কোনও পর্যায়ে কোনও বিভক্তি না থাকাকে তার রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।
জমা পড়েছে আবেদনের স্তূপ
সূত্র জানায়, দলটির এই শীর্ষ নেতা যুক্তরাজ্যে এক যুগের বেশি সময় থাকার পরও দেশে গত সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনের কূটনৈতিক পর্যায়ে দৃশ্যমান কোনও তৎপরতা ছিল না। তবে সামনে দলের সুদিন আসছে, সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দলে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় বিভিন্ন খাতের অনেকেই ভিড়তে চাইছেন তারেক রহমানের কাছাকাছি।
দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা নেতারাও তারেক রহমানের গুডবুকে থাকতে নানা কৌশল নিচ্ছেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে যারা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, সেসব বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য জমা পড়েছে আবেদনের স্তূপ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে, এমন এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারেক রহমানের নিযুক্ত একজন উপদেষ্টা ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক বিতর্কিত এমপির ভাতিজিকে বিয়ে করে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দলের জন্য ফেসবুকে একটি পোস্টও করেননি। কিন্তু দেশের পটপরিবর্তনের পর তিনিও গত ২০ আগস্ট বিএনপির স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে সদস্য হতে পেরেছেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। অতীতে দলের দুঃসময়ে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, এ রকম অনেকেই এখন নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প নিয়ে তারেক রহমানের অ্যাটেনশন সিক (মনোযোগ আকর্ষণ) করতে চাইছেন। নেতার দৃষ্টি কাড়তে চলছে নানামুখী তৎপরতা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে তারেক রহমান দেশের বাইরে থেকে দেশের প্রধান দলের প্রধান নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এক-এগারোর পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল এই বিপ্লব। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অতীতেও আন্দোলন করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।’
মেধাবীদের কাজে লাগাতে চান
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন তারেক রহমান শুধু যে দল গোছাচ্ছেন তা নয়, দেশের নতুন দিনের রূপরেখা নিয়ে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি সুযোগ পেলে প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি বিশ্বপরিমণ্ডলে কাজ করছেন, সেসব মেধাবীকে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চান। তিনি শুরু থেকে শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে যেসব নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন, অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন, সেসব পরিবারের পাশে ছিলেন।’
তারেক রহমানের নেতৃত্বে কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য একাধিক কমিটি থাকলেও বিগত দিনের দলের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতার কোনও অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন এম এ মালেক।
তিনি বলেন, সব কূটনৈতিক উদ্যোগ ও তার ফলাফল সব সময় দৃশ্যমান হয় না।
মালেক জানান, তিনি নিজে জাতিসংঘের পাঁচটি সম্মেলনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের জুলুম-নির্যাতন তুলে ধরেছেন। যুক্তরাজ্য বিএনপির ৪৫টি জোনাল কমিটির নেতারা নিজ নিজ আসনের ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। এ বিষয়গুলো তারা কৌশলগত কারণে সামনে আনতে চাননি।
তারেক রহমানের সাম্প্রতিক ব্যস্ততা নিয়ে কথা হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদের সঙ্গে।
শনিবার তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না বা দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, এগুলো অনেক আগেই তারেক রহমানই প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি আগামী নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন, নেতাকর্মীদের সময় দিচ্ছেন। তিনি দলকে শত বাধার মুখেও ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছেন। তিনি যেভাবে দলকে গুছিয়ে এনেছেন, সেটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যায় না। আমরা চাই সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনুক। সেই লক্ষ্যে তারেক রহমান এ সরকারকে শুরু থেকেই সমর্থন দিচ্ছেন।
সুবিধাভোগীদের দৌরাত্ম্য
যুক্তরাজ্য থেকে তারেক রহমান দেশে দলে স্বচ্ছতা ও প্রকৃত ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে চাইলেও, তা কিছু ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে। লন্ডন ও ঢাকায় ‘নেতার একান্ত নিজের লোক’ পরিচয়ে গড়ে ওঠা কিছু সিন্ডিকেটের কারণে একই ব্যক্তি টানা ২২ বছর ধরে বিএনপির জেলা কমিটির সভাপতি পদে রয়েছেন।
তারেক রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে যুগ্ম মহাসচিব পদ পাওয়ার পর নেতৃমূলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক ও দলের ভেতরে ডাটাবেজ তৈরি করেছেন। সেই ডাটাবেজে পর্যায়ক্রমে তৃণমূলের নেতাদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার ব্যক্তিগত চেষ্টায়। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে সক্রিয় রয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাজ্য বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০০১ সালে যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পর তার কাছের মানুষ পরিচয় দিতো একটি বলয়। সেই সিন্ডিকেটের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি দল ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও মিয়া নুরুদ্দিন অপু ছাড়া তাদের কেউ মামলার আসামি ছিলেন না। এ বিষয়গুলো তারেক রহমানের অজানা নয়। তিনি সব জানেন। তিনি দেশে ফিরে যখন সরাসরি দেশের জন্য কাজ শুরু করবেন, তখন অনেক কিছুই দৃশ্যমান হবে।