জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ধারাবাহিক বৈঠক ও আলোচনায় নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন দলের নেতাদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক, যেখানে আগামীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা নির্ধারণের ছক কাটা হচ্ছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত।
সর্বশেষ গত ২৪ ও ২৫ মে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বিশেষ বৈঠকে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি দলে নারী সদস্য ছিল না বললেই চলে।
বিএনপি ও জামায়াত: নারীবিহীন আলোচনার ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে বৈঠকে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল পাঠালেও তাতে কোনও নারী প্রতিনিধি ছিল না। একইদিন জামায়াতে ইসলামীও পুরুষ-প্রধান প্রতিনিধি দল পাঠায়। এই দুই বড় রাজনৈতিক দলের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে প্রতিটি বৈঠকেই নারী প্রতিনিধি ছিল অনুপস্থিত। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও বৈঠক কিংবা সাক্ষাতে কোনও নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি দল দুটি।
এনসিপি ও এবি পার্টি: কিছুটা ব্যতিক্রম
নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) রাষ্ট্রীয় বৈঠকে অংশগ্রহণের সুযোগ কম পেয়েছে। তবে নারী প্রতিনিধি নিশ্চিতে তাদের প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। গত ২৩ মার্চ একজন নারীসহ গঠিত প্রতিনিধি দল বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে দলটির লিখিত মতামত ঐক্যমত্য কমিশনের কাছে জমা দেয়। এবং গত ১৯ এপ্রিল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুইজন নারী সদস্য, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারওয়ার নিভাকে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যদিও ৬ মে’র বৈঠকে এ ধারা রক্ষা হয়নি। সর্বশেষ ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারার উপস্থিতি দেখা যায়।
অন্যদিকে, এবি পার্টি নারীর অংশগ্রহণে কিছুটা অগ্রগামী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় বৈঠকে তারা অন্তত একজন নারী প্রতিনিধি সঙ্গে রাখে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে তারা নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ, ৭ এপ্রিল এবং ১৫ মে তারিখে ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকার ও বৈঠকগুলোতে পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি ও নারী বিষয়ক সম্পাদক ফারাহ নাজ সাত্তারের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
বাম ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর উপস্থিতি হতাশাজনক
ধারাবাহিকভাবে প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বাম ঘরানার দলগুলোর মধ্যে গণসংহতি আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ-সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি অংশগ্রহণ করে। এর বাইরে এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ বেশ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল অংশ নিলেও, সেখানে নারীর উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক।
এদের মধ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) পক্ষ থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রব প্রতিনিধিত্ব করেন।
এছাড়া বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি গত ২৭ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার প্রস্তাবনার বিষয়ে মতামত জমা দেওয়ার সময় পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালীকে সঙ্গে রাখে। এবং ২৯ এপ্রিলের ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে রাশিদা বেগম ও বহ্নিশিখা জামালীকে অন্তর্ভুক্ত করে।
এর বাইরে অধিকাংশ দলই একেবারেই নারী নেতৃত্বকে উপেক্ষা করেছে।
তালিকা সীমিত, ঠাঁই হয় না নারীদের
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বড় দলগুলোর প্রতিনিধি দলের তালিকায় বেশ কয়েকজন রাখা হলেও, ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে সেটি হয় একজন কিংবা দুইজনের প্রতিনিধি দল। সেই তালিকায় আবার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের নাম থাকে। অর্থাৎ, অধিকাংশ দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেহেতু পুরুষ, তাই রাষ্ট্রীয় বৈঠকে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম।
তবে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ছাড়া অন্য ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে দলগুলোর আগ্রহ দেখা যায় না।
এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বড় দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলোর জন্য কখনও একজন, কখনও দুইজন প্রতিনিধির তালিকা রাখা হয়। এর মধ্যে অবশ্যই দলের যারা প্রধান তাদের যেতে হয়। সুতরাং, নারী প্রতিনিধি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।’
দলগুলোতে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এখনও প্রবল!
রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে নারীদের জন্য পদ সংরক্ষিত থাকলেও বাস্তবে তাদের মতামতের গুরুত্ব খুব কমই দেওয়া হয়— এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ। অনেকে মনে করেন, নারীদের রাখা হয় শুধুই আলঙ্কারিক পদে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও নীতিনির্ধারণী আলোচনায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় অনুপস্থিত।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারী অধিকারের কথা মুখে বলা হলেও অধিকাংশ দলের গঠনতন্ত্রে সেই অধিকার কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে দেখা যায়, দলের উচ্চ পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, সেটিও আলঙ্কারিক মাত্র।’
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে এখনও একটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এমনকি প্রগতিশীল দলগুলো, যারা নারী অধিকারের পক্ষে সোচ্চার, তারাও দলের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে নারীদের অংশগ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আলোচনায়ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় না। নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে নিয়ে আসা হয় না।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ অনিবার্য
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নারীদের অনুপস্থিতি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। নারী নেতৃত্বকে সমর্থন জানানো সত্ত্বেও, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বৈঠকে পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অভাবকে স্পষ্ট করে তুলছে বলে মনে করেন নারী অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে ‘সমতার রাজনীতি’র ধারণা কেবল নীতিগত বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এ বিষয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা খুবই হতাশাজনক। নারী রাজনীতিকরা কেবল সাংগঠনিক বা নির্বাচনি কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, সিদ্ধান্তগ্রহণের কেন্দ্রেও থাকতে হবে, এটাই হচ্ছে আসল অন্তর্ভুক্তি। বৈঠকগুলো সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ।’
নারী অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘আমরাই পারি’-র প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী অধিকার বলতে শুধু তাদের শিক্ষিত হয়ে চাকরিতে যুক্ত হওয়াকেই বুঝি। কিন্তু তারা যে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা আমরা উপেক্ষা করি। অথচ রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলে, সমাজের সাধারণ নারীদের অধিকার নিয়ে কে বলবে? পুরুষদের কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করা যায় না, কারণ তারাই তো নারীদের কোণঠাসা করে রেখেছে।’
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার প্রয়োজন রয়েছে বলে জিনাত আরা হক মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার যেহেতু পরিবর্তনের কথা বলছে, তাদের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা। প্রয়োজনে বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে— যেসব দলে নারী প্রতিনিধি নেই, তাদের নারী সদস্যদের সঙ্গে নিয়েই বৈঠকে অংশ নিতে হবে।’