লোহা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়, তেমনি পরিশ্রম করে নিজেকে খাঁটি ‘সোনায়’ রূপ দিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। বলের গতি তো আগে থেকেই ছিল, ছিল কারিকুরি করার ক্ষমতাও। এখন যোগ হয়েছে ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক। এসব মিলিয়ে তাসকিন হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পেস আক্রমণের মূল অস্ত্র। বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
বলা হচ্ছে এই তাসকিন ভিন্ন এক তাসকিন, প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজে কীভাবে অনুপ্রাণিত করছেন?
তাসকিন আহমেদ: আসলে হয়তো আগের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে একটু ভালো হয়েছে, উন্নতি হয়েছে। এখনও অনেক উন্নতি করার আছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে অনুপ্রেরণা দেওয়াটাই মূল ব্যাপার। আমার যে প্রসেস আছে সেটা মেনে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। ম্যাচে খারাপ খেলি কিংবা ব্যর্থ হই, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিজের উন্নতি করার চেষ্টা এবং প্রসেসের মধ্যে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আমাকে আগের চেয়ে ভালো হতে সাহায্য করেছে। তবে আরও অনেক উন্নতি করার বাকি আছে।
সত্যিকার অর্থেই আপনার যে জীবনযাপন ছিল, সেখান থেকে এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়া বেশ কঠিনই। বিশেষ কোনও প্রেরণা নিশ্চয়ই ছিল।
তাসকিন: দল থেকে বাদ পড়তে কারোই ভালো লাগে না। দলের বাইরে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ মানসিক কষ্টের ছিল। অনেক দিন বাইরে থাকার পর করোনা শুরু হলো। ওই সময়টাতে ফেরার লড়াইয়ের চেষ্টা করি। আমার লাইফস্টাইল বদলে ফেলার চেষ্টা করি। একেবারে ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। একজন সত্যিকারের ফাস্ট বোলার যা করে, সেগুলোই করেছি। সব কিছু উন্নতি করে দলে আসার চেষ্টায় ছিলাম। ইচ্ছা ছিল জাতীয় দলের হয়ে একটা ম্যাচ হলেও আবার খেলবো। আপনি প্রশ্ন করলেন না, কীভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছি? তাহলে শুনুন, সবাই বলাবলি করতো তাসকিন ফিনিশড, মাঠে ও মাঠের বাইরে সবাই আমাকে ইগনোর করতো। ওই জিনিসগুলো খারাপ লাগতো। ওখান থেকেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া, আমি ক্যামব্যাক করবো। আল্লাহর রহমতে স্বপ্ন এখন অনেক বড়। অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখি, দেখা যাক আল্লাহ ভরসা। তবে এতটুকু বলতে পারি, আমার প্রতিযোগিতা একমাত্র নিজের সঙ্গেই।
গত কয়েক বছরে আপনার স্কিলের দারুণ উন্নতি হয়েছে, বিশ্বকাপকে ঘিরে বিশেষ কোনও পরিকল্পনা আছে?
তাসকিন: আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতি করার ইচ্ছা আছে। বেসিক জিনিসগুলো সার্ভ করা এবং ডে বাই ডে নতুন নতুন স্কিলের উন্নতি করা, এটাই মূল লক্ষ্য। আর বিশ্বকাপ ঘিরে কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা সেটা যদি বলে দেই তাহলে তো প্রতিপক্ষ ব্যাটাররা জেনে যাবে। সেটা এখন না বলাই ভালো (হাসি)।
নতুন বলে তো বরাবরই ভালো হচ্ছে, পুরনো বলে আরও উন্নতির প্রয়োজন মনে করছেন?
তাসকিন: সত্যি কথা বলতে, উন্নতির তো শেষ নেই। নতুন বল আর পুরনো বল-দুই জায়গাতেই উন্নতি হয়েছে। আমি আমার প্রসেস অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি মনে করি সঠিক পথে আছি। এই প্রসেসে থাকতে পারলে সামনে আরও উন্নতি দেখবেন।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, প্রায় দশ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন, তাসকিন এখন কতটা পরিণত?
তাসকিন: মনে তো হচ্ছে হয়েছি (হাসি)। এটা পুরোটা নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। মানুষ খেলতে খেলতেই শেখে, ভুল করে করেই শেখে। অনেক বছর তো হলো খেলছি। তবে আমার উন্নতি আপনি বা আপনারা হয়তো আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমি কেবল পরিশ্রম করছি, চেষ্টা করছি নিজেকে এক স্তর থেকে আরেক স্তরে নিয়ে যেতে।
ইনজুরির কারণে ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি, হোম অব ক্রিকেটের চত্বরে আপনার কান্না ক্রিকেটপ্রেমীদের ছুঁয়ে গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে চার বছর পর আপনিই অধিনায়কের মূল ভরসা। ভাবতে কেমন লাগে?
তাসকিন: ২০১৯ বিশ্বকাপে বাদ পড়াটা আমার জন্য আনন্দদায়ক ছিল না। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আল্লাহ আসলে যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। ওই সময় বাদ না পড়লে নিজেকে এভাবে পরিবর্তনের তাড়না পেতাম না, নিজেকে বদলানোর ইচ্ছাটাও জাগতো না। এখন দলের নিয়মিত সদস্য হতে পেরে খুব ভালো লাগে। তবে নিজের প্রসেস মেইনটেইন করে এটা ধরে রাখতে হবে। কারণ দিনশেষে পারফরম্যান্স না করলে দলে জায়গা হারাতে হবে। চ্যালেঞ্জ সবখানেই। আমি অবশ্য সব ধরনের চ্যালেঞ্জ নিতে শিখে গেছি। সত্যি বলতে চ্যালেঞ্জটা এখন উপভোগ করি।
২০১৫ বিশ্বকাপে তরুণ তাসকিন ঝলক দেখিয়েছিল, আরও একটি বিশ্বকাপ যখন সামনে, তাসকিনের কাছ থেকে দর্শক কী প্রত্যাশা করবেন?
তাসকিন: ২০১৫ বিশ্বকাপে খুব ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। আল্লাহ চাইলে এবার হয়তো আরও ভালো কিছু হবে ইনশাআল্লাহ। দিন যত যাবে, সবার প্রত্যাশা অনেক উঁচুতে থাকবেই। কার মনে কী প্রত্যাশা, এটা চিন্তা করে নিজের ওপর চাপ বাড়াতে চাই না। আমার কাজগুলো ঠিকমতো করে যেতে চাই। দিন শেষে ভালো করলে, দল জিততে পারলেই হবে। এটাই আমার মূল লক্ষ্য।
অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেলে বাংলাদেশ দলটি বেশ ব্যালেন্সড, এমন দল নিয়ে বিশ্বকাপে কতদূর যাওয়া সম্ভব?
তাসকিন: আমাদের দলটা মাশাআল্লাহ আগের থেকে অনেক ভালো এবং ব্যালেন্সড অবস্থায় আছে। প্রতিনিয়ত সবাই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। আশা করি, আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটটা খেললে এই দল নিয়ে সেমিফাইনাল, ফাইনাল দুটোই সম্ভব। বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে নয়টা ম্যাচ, কমপক্ষে তো পাঁচটা জিততেই হবে। আমরা অনেক আশাবাদী। দেখা যাক।
স্কিলের দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন কি যুক্তিসঙ্গত?
তাসকিন: সেরা ক্রিকেট খেললে তো সম্ভব, একটু আগেই বললাম। সেমিফাইনালে গেলে তারপর তো একটা ম্যাচই। ফাইনালে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব।
তাসকিন নিজে কি বিশ্বাস করে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে বাংলাদেশ?
তাসকিন: আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ফাইনাল খেলা সম্ভব। আমরা নিজেদের সেরা ক্রিকেটটা মাঠে খেলতে পারলেই হবে।
ভারতে সাতটি ভেন্যুতে খেলতে হবে বাংলাদেশকে, একেক ভেন্যুর উইকেটের চরিত্র একেকরকম। উইকেটের চরিত্র নিয়ে আপনি কিংবা আপনার দল কতখানি ওয়ার্কআউট করছে?
তাসকিন: দুনিয়ার সব ভেন্যুতেই একেকটি উইকেটের আচরণ একেক রকম। নির্দিষ্ট দিনে উইকেটের আচরণ অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতে হবে। উইকেট আসলে কখনোই অজুহাত হতে পারে না। উইকেট যেমনই হোক, আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই হবে। এটাই মূল লক্ষ্য।
আপনার সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বলেছেন, বিশ্বকাপের শীর্ষ তিন উইকেট শিকারির তালিকায় আপনাকে দেখছেন? আপনিও নিশ্চয়ই এমন কিছুই ভাবছেন?
তাসকিন: মাশরাফি ভাইয়ের মতো লিজেন্ডারি ক্রিকেটারের কাছ থেকে যেকোনও বার্তাই আমার জন্য অনেক আনন্দদায়ক। ভাইয়ের মুখের কথাটা যেন সত্যি হয়। চেষ্টা করবো তার মুখের কথাটা সত্যি করতে। মাশরাফি ভাইয়ের কাছ থেকে এমন বার্তা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে।
এবার বলুন ব্যাটার তাসকিনের প্রস্তুতি কেমন?
তাসকিন: সময় সুযোগ পেলে অনুশীলন করি। আগেও বলেছি, আমি ভালো একজন টেলএন্ডার হতে চাই। যাতে কখনও কোনও ক্লোজ ম্যাচ হলে, অপর প্রান্তে সেট ব্যাটার থাকলে তাকে সহায়তা করতে পারি। স্কিলের উন্নতি করতে পারলে নিজের ও দলের লাভ। সেই উদ্দেশ্যেই উন্নতি করার ইচ্ছা আছে।
হুট করে অধিনায়ক বদল, তারপর সাকিবের দায়িত্ব নেওয়াকে কীভাবে দেখছেন?
তাসকিন: হুট করে অধিনায়ক পাল্টানোতে আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনও প্রভাব পড়বে না। কারণ দিনশেষে তো আমরা সবাই টিমমেট। একসঙ্গেই খেলছি দীর্ঘদিন ধরে। সবার একে অপরের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক। যিনিই অধিনায়ক থাকুন না কেন, দিনশেষে সবার একটাই লক্ষ্য– দলকে জেতানো। আমাদেরও সবার লক্ষ্য তাই। এক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়বে না।
কয়েক বছর ধরে ইবাদত হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলাম, আপনিসহ ৫ পেসার দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সেরা পেস আক্রমণ এটাই?
তাসকিন: শেষ কয়েক বছর ধরে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। পরিসংখ্যান ও সবকিছু অনুযায়ী আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের সেরা পেস বোলিং ইউনিট। আমাদের সঙ্গে এবাদত ছিলেন, তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার খারাপ লাগছে। কারণ সে অনেক উন্নতি করেছে। সে আমাদের দলের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার, যে ১৪০ গতিতে বোলিং করে। তাকে কিছু কিছু ভেন্যুতে দরকার হতো। তার জন্য অনেক দোয়া থাকলো, যেন দ্রুত সুস্থ ও ফিট হয়ে আবারও দলে ফিরে আসে।