২০০৭ সাল, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। পোর্ট অব স্পেনে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে গোটা বিশ্বে হইচই ফেলে দেয় তারা। কিন্তু ওটাই শেষ। এরপর আরও তিনটি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে খেললেও কোনোটিতে শেষ হাসি হাসতে পারেনি লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। সময়ের হিসেবে ১৬ বছর, কিন্তু পরিণতি ওই একই। বিশ্বমঞ্চে চতুর্থবারের দেখাতেও গল্পটা বদলায়নি।
বৃহস্পতিবার নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান না থাকায় ভারতের বিপক্ষে একটু বেশিই ভুগতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে! বাঁহাতি অলরাউন্ডারের বদলে সুযোগ পাওয়া নাসুম আহমেদকে ছক্কায় উড়িয়ে পুনেতে বিরাট কোহলির ৪৮তম সেঞ্চুরি উদযাপন। আর তাতেই আরও একবার পুরোনো সেই হতাশার গল্পই রচনা হলো নতুন আরেকটি ভেন্যুতে।
২০১৫ সালের কোয়ার্টার ফাইনাল দুই দলের লড়াইটা হয়েছিল জমজমাট। ওই অগ্নিঝরা ম্যাচের পর থেকে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলা মানে চিত্তাকর্ষক ম্যাচ। ২০১৫ সালের পর বার্মিংহ্যামে ২০১৯ বিশ্বকাপের ম্যাচে লড়াই করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চার বছর পর আরও একটি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নেমে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দায়িত্বে থাকা দল। তিন বিভাগে এমন ছন্দহীন পারফরম্যান্সের খেসারত দিলো ৫১ বল আগে ৭ উইকেটে হেরে।
পুনের ব্যাটিং স্বর্গে প্রথম ইনিংসেই মূলত পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। যে মাঠে ওভার প্রতি গড় রান ছয়ের ওপরে, সেখানে ২৫৬ রান ভারতের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের দলের জন্য মামুলিই বটে। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে রোহিত-শুবমান-কোহলিরা বুঝিয়ে দিলেন সেটাই। বাংলাদেশ দল তাদের ইনিংসে বেশ কয়েকটি জায়গায় স্লো ব্যাটিং করেছে, এর কারণে তিনশর স্বপ্ন দেখালেও সেটি বাস্তব হয়নি। ২৫৭ রানের মামুলি লক্ষ্যে খেলতে নেমে সহজ ও সাবলীলভাবেই ব্যাটিং করেছে ভারত। স্বাগতিকদের অধিনায়ক রোহিত শর্মা বিস্ফোরক ইনিংস খেললেও হাফ সেঞ্চুরি করতে পারেননি। ৪০ বলে ৪৮ রানে হাসান মাহমুদের শর্ট বলে তাওহীদ হৃদয়ের তালুবন্দি হন তিনি। তবে তাকে আউট করে ‘খাল কেটে কুমির’ নিয়ে আসে বাংলাদেশ! মাঠে নেমেই নো বলে হাতখুলে খেলার সুযোগ পেয়ে যান কোহলি। ভারতের তারকা এই ব্যাটার বাংলাদেশের বোলারদের ছন্নছাড়া বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে ৪৪ রানের জুটি গড়েন গিলকে সঙ্গে নিয়ে। মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত ক্যাচে সাজঘরে ফেরার আগে গিলও খেলেন ৫৫ বলে ৫৩ রানের ইনিংস। শ্রেয়াস আইয়ার (১৯) বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি।
আইয়ার ফেরার পর শুরু হয় কোহলির তাণ্ডব। ৪৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর সেঞ্চুরির পথেই ছিলেন। কিন্তু পাঁচ নম্বরে নামা লোকেশ রাহুল কিছু শটস খেলায় লক্ষ্যের ব্যবধান কমে গেলে কোহলির সেঞ্চুরির আশা ফিঁকে হতে থাকে। ৪০ ওভার শেষে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৮ রান। অন্যদিকে কোহলির ৪৮তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির জন্য প্রয়োজনও সমান সংখ্যক রান।
৪১তম ওভারে প্রথম বলে ওয়াইড দিয়ে ভারতীয় সমর্থকদের টেনশন বাড়িয়ে দেন কোহলি। পরে হাসান মাহমুদের এই ওভারে দুটি ডাবলস ও শেষ বলে একটি সিঙ্গেল নিয়ে তুলে ফেলেন ৫ রান।
৪২তম ওভারে কোহলির প্রয়োজন তিন রান, কিন্তু দলের প্রয়োজন ২ রান। নাসুমের প্রথম দুই বল ডট দিলেও তৃতীয় বলে বিশাল ছক্কায় বলকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে সেঞ্চুরি উদযাপন করেন। আর তাতেই কিং কোহলির দারুণ সেঞ্চুরিতে ভারত ৭ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে।
অল্প পুঁজিতে ভারতের বিপক্ষে বোলিং করতে নেমে খেই হারিয়ে ফেলেন বাংলাদেশের বোলাররা। প্রায় প্রতি ওভারেই বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি হজম করতে হয়েছে বোলারদের। তাসকিনকে বিশ্রাম দিয়ে হাসানকে সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি ত্রাস ছড়াতে পারেননি। বাকি দুই পেসার শরিফুল ও মোস্তাফিজ গড়পড়তা বোলিং করেছেন। নাসুম তো বেধড়ক মার খেয়েছেন ভারতের ব্যাটারদের হাতে।
পুনের ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে বোলারদের দায় তেমন একটা দেওয়া যায় না। যে মাঠে তিনশর কম রান করে জেতার ইতিহাস নেই, সেখানে প্রতিপক্ষকে ২৫৭ রান লক্ষ্য দিয়ে কীভাবে জেতা সম্ভব? তার মধ্যে ছিলেন না নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব। তার ব্যাটিং-বোলিংই শুধু নয়, অধিনায়কত্ব খুব মিস করেছে বাংলাদেশ দল। তারপরও পুনের ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শান্ত।
ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের দুই ওপেনার লিটন দাস ও তানজিদ হাসান তামিম বিশ্বকাপের সেরা ওপেনিং জুটির রেকর্ডও করে ফেলেন। প্রথম পাওয়ার প্লের ৫ ওভারে মাত্র ১০ রান নিতে পারেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার। এখানেই কিছুটা পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। যদিও ৬ষ্ঠ ওভার থেকে জুনিয়র তামিম পুনের ২২ গজে তাণ্ডব চালান। পরের পাঁচ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ৫৩ রান। শুরুর ৫ ওভার ব্যাটিংয়ের হতাশা নিমেষেই ভুলিয়ে দেন তানজিদ তামিম। যশপ্রীত বুমরা, শার্দুল ঠাকুর, মোহাম্মদ সিরাজ কেউই পাত্তা পায়নি তার কাছে। তবে দুর্ভাগ্য তার প্রথম আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েই ৫১ রানে কুলদীপ যাদবের শিকার হন তিনি। তার আগে ৯৩ রানের জুটি গড়েন লিটন-তানজিদ। যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিতে সর্বোচ্চ রান। আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ৬৯। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিলেন মেহরাব হোসেন ও শাহরিয়ার হোসেন।
জুনিয়র তামিম ফেরার পরেই মোড়ক লাগে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে। ১৩৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি করে চতুর্থ ব্যাটার হিসেবে আউট হন লিটন। ৬৬ রানের সময় রবীন্দ্র জাদেজাকে লং অফে বড় শট খেলতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে আসেন গিলের হাতে। সেখান থেকে ম্যাচের হাল ধরার চেষ্টা করেন মুশফিকুর রহিম ও তাওহীদ হৃদয়। ধাক্কা সামলে ভারতের ব্যাটারদের ভালোই জবাব দিচ্ছিলেন বগুড়ার দুই ক্রিকেটার। কিন্তু হুট করেই বড় শট খেলতে গিয়ে সাজঘরে ফেরেন হৃদয়। তার আউটের মধ্যে দিয়ে দুজনের ৪২ রানের জুটিও ভাঙে।
শেষ দিকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে ফিনিশিং দেওয়ার চেষ্টা করেন মুশফিক। কিন্তু নিজে ৩৮ রানে আউটে হন। আউটের আগে অবশ্য বিশ্বকাপে এক হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মুশফিক। তার আগে এই কীর্তি গড়েছেন সাকিব। বাঁহাতি ব্যাটারের ১২০১ রানের বিপরীতে ১০৩৪ রান মুশফিকের।
উইকেট কিপার এই ব্যাটার আউট হওয়ার পর ফিনিশিং টাচ দেন মাহমুদউল্লাহ। ফিনিশার হিসেবে পরিচিত ডানহাতি এই ব্যাটার নিজের দক্ষতা আরেকবার প্রমাণ করেছেন। নাসুমের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ৩২ রানের জুটি গড়েছেন তিনি। তার অনবদ্য ৪৬ রানের ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ২৫৬ রান করতে পেরেছে।
তানজিদ-লিটন-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের এই লড়াই জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তো পোর্ট অব স্পেনকে ১৬ বছর পরও ফিরিয়ে আনা গেলো না পুনের ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে।