ছেলে-মেয়েদের সাফল্যের পেছনে বাবা-মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মায়েদের। তাদের সংগ্রাম বলে কয়ে শেষ করা যাবে না। সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সন্তানদের সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারলেই তারা সন্তুষ্ট। এমন একজন মা হলেন মৌমন রেজা। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া দাবাড়ু মনন রেজা নীড়কে ঘিরে বড় স্বপ্ন তার। সেই স্বপ্নের পথে দারুণভাবে হেঁটে চলেছেন বড় ছেলে নীড়। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছেন। শত কষ্টের মধ্যেও মা মৌমন রেজা হাল ছাড়েননি। ছেলেকে গ্র্যান্ডমাস্টার করবেন-এমন পণ নিয়ে সেই পথেই হেঁটে চলেছেন তিনি।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাস্টারদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান ১৪ বছর বয়সী মনন রেজা নীড়। জাতীয় দাবার শিরোপা তো জিতেছেন আগেই। বিশ্বের অন্যতম সেরা গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। যেভাবে এগুচ্ছেন তাতে করে দেশের ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হতে হয়তো আর বেশি দিন বাকি নেই। অথচ নীড়ের এই পর্যন্ত আসার পেছনে মা মৌমন রেজার অবদান অনেকটাই। ৯ বছর আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়মিত জ্যাম ঠেলে পল্টনের দাবা ফেডারেশনে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। সেই থেকে ছেলের ধ্যান-জ্ঞ্যান দাবার ৬৪ ঘরকে কেন্দ্র করেই। এখানে শুধু একজন মা তার ছেলেকে খেলতে নিয়ে আসতেন- তা সাদা চোখে দেখা সহজ বিষয়। কিন্তু একটু অন্দরমহলে প্রবেশ করলে দেখা যাবে তাদের কষ্টের কোনও পরিসীমা নেই।
নীড়ের মা মৌমন রেজা ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে শ্রাবণী পোদ্দার থেকে হয়েছেন মৌমন রেজা । সবকিছু ভালো চলছিল। তবে দেড় যুগের বেশি সময় সংসার করার পর প্রায় বছর তিনেক আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। এখন নীড় ও তার ছোট ছেলেকে ঘিরেই মায়ের যতো স্বপ্ন। শত কষ্টের মধ্যে ছেলেকে বড় দাবাড়ু বানানোর স্বপ্নে এখন তারা ঢাকার মোহাম্মদপুরে থিতু হয়েছেন। ছেলেকে যেমন বড় দাবাড়ু হিসেবে গড়তে চান। পাশাপাশি ছেলের উচ্চ শিক্ষাতেও রাখছেন মনোযোগ।
মৌমন রেজা বাংলা ট্রিবিউনকে নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘নীড়ের মধ্যে দাবা প্রেম একদম ছেলেবেলা থেকে। তাই ওর স্বপ্ন পূরণ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাশাপাশি লেখাপড়াটা যেন ভালো করে করতে পারে। কোনওভাবেই যেন শিক্ষার পরিবেশ থেকে দূরে সরে না যায় তাই রেসিডেনসিয়াল স্কুলে ভর্তি করেছি। ওর স্কুলের শিক্ষকরাও ওকে সহযোগিতা করে থাকে। এখন দুটোই চলছে এক সঙ্গে।’
সিঙ্গেল মা হয়েও কষ্টকে মেনে নিয়েছেন মৌমন রেজা। একটাই লক্ষ্য দুই ছেলেকে নিয়ে দেশের জন্য কিছু একটা করে দেখানো। মৌমন রেজা বলেছেন, ‘আমি চাই আমার ছেলেরা দেশের জন্য কিছু একটা করে দেখাক। নীড় দাবায় বেশ ভালো করছে। ও যদি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। তখন সব কষ্ট স্বার্থক হবে।’
একসময় বাবার পাশাপাশি মা সন্তানদের দেখেছেন। গত কয়েক বছর ধরে মা-ই সব। এখন অবশ্য ৩জনের সংসারের দায়িত্ব আবার ১৫ বছর বয়সী নীড়ের কাঁধে। মৌমন রেজা বলছিলেন, ‘আমার এই বাচ্চা ছেলের আয়েই কিন্তু সংসার চলছে। নীড় বর্তমানে নৌবাহিনীর হয়ে খেলছে। নীড়ের মাসিক সম্মানী ৩০ হাজার টাকা। এ দিয়ে অনেক কষ্টে আমাদের সংসার চলছে। এর মধ্যে ওর বাইরে খেলাসহ অনেক কিছুই ম্যানেজ করতে হচ্ছে। আসলে আমার ছেলে বলেই না, নীড় কিন্তু ন্যাচারাল ট্যালেন্ট। নিজের মেধার যোগ্যতা দিয়ে এই পর্যন্ত এসেছে। আমি চেষ্টা করছি শুধু সামনের দিকে এগিয়ে নিতে।’
পোস্তগোলার মায়ের বাসা থেকে নারায়ণগঞ্জ। এরপর মোহাম্মদপুর। দুই ছেলেকে নিয়ে সংগ্রামী মায়ের জীবন। ছেলে নীড়েরও মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, ‘মায়ের জন্যই আজ আমি দাবাড়ু নীড়। নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি আমাকে নিয়ে আসতেন। ফেডারেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। মায়ের সহযোগিতা ছাড়া আমার দাবা খেলা হয়ে উঠত না। আমার সবকিছুই মাকে কেন্দ্র করে। আমি তো শুধু খেলি। স্পন্সর ও অর্থ জোগাড় সব কিছুই মা করেন। মা আমাকে বিদেশে খেলতে পাঠানোর জন্য স্পন্সরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবর্ণনীয় কষ্ট করেন।’
নীড়ের মা শুধু নন, এমন মা আছেন চারদিকে। তাই মা দিবসে সন্তানদের ভালোবাসাই তাদের পাথেয়।