ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ২১তম গ্র্যান্ডমাস্টার্স আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে জুন মাসের শুরুতে ভারতে পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি দাবাড়ু রানী হামিদ। কিন্তু সঙ্গী রেটিংধারী খেলোয়াড়কে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন ৮০ বছর বয়সী এই নারী।
রানী হামিদের সঙ্গী ৩৭ বছর বয়সী আছিয়া সুলতানা দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ভারতের ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) তাকে ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আগেরবার চিকিৎসার ভিসায় ভারতে গিয়ে তিনি কলকাতায় এক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন, যা ভিসা শর্ত ভঙ্গের আওতায় পড়ে।
এ কারণে আছিয়াকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন হোল্ডিং সেন্টারে রাত কাটাতে হয়। তাকে নিজের লাগেজও দেখতে দেওয়া হয়নি। পরদিন নিজ খরচে দ্বিগুণ দামে ফিরতি টিকিট কিনে ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি।
এই ঘটনায় প্রচণ্ড মর্মাহত রানী হামিদ ভারতের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, আমার খুব খারাপ লাগছে। যে মানুষটি আমার সঙ্গে এসেছিল, তাকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুরো রাত তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, তার ব্যাগও দেওয়া হয়নি। পরদিন জোর করে তাকে দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই মানসিক বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছে টুর্নামেন্টে তার খেলাতেও। প্রথম ছয় রাউন্ডের মধ্যে রানী হামিদ জয় পেয়েছেন মাত্র একটিতে এবং একটি ড্র করেছেন তুলনামূলক কম রেটিংপ্রাপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে।
তিনি বলেন, আমি কখনও একা ভ্রমণ করি না। বয়সের কারণে সব সময় সঙ্গী রাখি। এবার আছিয়া ছিল আমার সঙ্গে। এখন আমি একা হয়ে গেছি। মনোযোগ দিতে পারছি না খেলায়।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার (ডব্লিউআইএম) খেতাব পাওয়া রানী হামিদ আরও বলেন, তার পাসপোর্টে কোনও সমস্যা ছিল না। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক ছিল। তারপরও তাকে বলা হলো, আগের বার সে মেডিক্যাল ভিসায় এসেছিল কিন্তু দাবা খেলায় অংশ নিয়েছিল। সেটাই নাকি অপরাধ। অথচ তাকে তখন কেউ বলেনি এটা বেআইনি। আগে জানলে সে কখনও আসতো না। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনকে আগেই জানানো উচিত ছিল।
তিনি বলেন, আমি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের অনেক অনুরোধ করেছিলাম, আপনারা জরিমানা করেন, ১০০ ডলার, ২০০ ডলার, যাই হোক—কিন্তু ওকে খেলতে দিন, মাত্র সাত দিনের জন্য। সে কোনও অপরাধ করেনি। কাউকে হত্যা করেনি, চুরি করেনি, ডাকাতিও করেনি। শুধু দাবা খেলেছে।
তবে এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দিল্লি দাবা অ্যাসোসিয়েশনের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছেন তিনি। দিল্লির ছত্রপুরে অবস্থিত টিভোলি রিসোর্টে আয়োজিত প্রতিযোগিতার ভেন্যু ও আবাসন একই স্থানে হওয়ায় তিনি খেলায় অংশ নিতে পেরেছেন বলে জানান।
রানী হামিদ বলেন, খুব আরামদায়ক পরিবেশ। আমার কক্ষ থেকে খেলার স্থান মাত্র ৫ মিনিট হাঁটার পথ। আয়োজকরা আমাদের যেভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং টিকিট পাঠিয়েছে তাতে আমি কৃতজ্ঞ।
এ বিষয়ে দিল্লি দাবা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভরত সিং চৌহান বলেন, এই ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এ ধরনের ভিসা সমস্যা প্রায়ই হয়। সম্ভবত আগেরবার আছিয়া চিকিৎসা ভিসায় এসেছিলেন এবং দাবা খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এর ফলে কেউ হয়তো অভিযোগ করেছেন। তাই এফআরআরও তাকে ব্ল্যাকলিস্ট করেছে। এসব সমস্যা বড় ইভেন্ট আয়োজনের অংশ হিসেবেই দেখতে হয়।
এদিকে রানী হামিদের দিল্লির এই টুর্নামেন্ট শেষ করে মুম্বাইয়ে আরেকটি টুর্নামেন্ট খেলার কথা। আছিয়া দেশে চলে আসায় তার মুম্বাইয়ে খেলা সম্ভব হচ্ছে না। রানী হামিদের দ্রুত সময়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন তার বড় ছেলে সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদ, 'আম্মার বিদেশে একা থাকা অনেক কষ্ট। আছিয়া মায়ের সঙ্গে কয়েকটি টুর্নামেন্টে সফরসঙ্গী হয়েছিল। এখন আছিয়া না থাকায় মায়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। তিনি অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। ভালো খেলতেও পারছেন না। খুব চিন্তায় রয়েছি আমরা।'