বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী হেমন্তের আরও পাঁচ দিন বাকি। তবে এরই মধ্যে উত্তরের সীমান্ত জেলাগুলোতে দেখা দিয়েছে শীতের প্রকোপ। গত কয়েকদিন ধরেই ভোরে দেখা দিচ্ছে প্রচণ্ড কুয়াশা। বইছে হিমেল হাওয়া। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসও জানান দিচ্ছে, অন্যান্য বছরের মতো এবারও সারা দেশের তুলনায় আগেভাগেই শীত আসছে উত্তরের জেলাগুলোতে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ ভারতের বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
বাংলা ট্রিবিউনের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে উত্তরের সীমান্ত জেলাগুলোতে শীত জেঁকে বসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভোরের কুয়াশা ও হিমেল হাওয়া বাগড়া বসাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের কাজে।
শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল ও নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। সারা দেশের রাতের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে পারে এবং দিনের তাপত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামীকাল সোম ও মঙ্গলবারের আবহাওয়ার একই রকম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাভাসে দেওয়া অনুমান সত্য করে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ঘন কুয়াশায় প্রায় সাড়ে ৮ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। শনিবার (৯ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে কুয়াশার ঘনত্ব বেড়ে গেলে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখে ঘাট কর্তৃপক্ষ। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুয়াশা কেটে গেলে পুনরায় ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
তবে দীর্ঘক্ষণ ফেরি বন্ধ থাকায় দৌলতদিয়া ঘাট প্রান্তে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, ট্রাক, যাত্রীবাহী বাসসহ প্রায় দুই শতাধিক যানবাহন আটকা পড়েছে। এতে যাত্রী, চালকরা তীব্র শীতে ভোগান্তিতে পড়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ১৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে ৩০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়াও নওগাঁর বদলগাছী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াতেও তাপমাত্রার পারদ ছিল সর্বনিম্ন ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে।
বাংলা ট্রিবিউনের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বরাবরই সীমান্ত এই জেলায় শীতের আগমন একটু আগেভাগেই হয়। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখনই সন্ধ্যার পরে রীতিমতো হিমবাহ বইতে থাকে, কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভোরের প্রকৃতি। ভারতের দার্জিলিং, নেপাল, ভুটান খুব কাছে হওয়াতে শীত এবং হিমবাহের তীব্রতা থাকে বেশি। যার ফলে দিনের খুব কম সময়ের ফারাকেই শীতের তীব্রতা কমা বাড়া করে। কুয়াশারও একই পরিস্থিতি। কুয়াশা পড়তে শুরু করলেই জনজীবন হয়ে যায় বিপর্যস্ত।
স্থানীয় এক অটোরিকশা চালক আনিছার রহমান বলেন, ‘রাতের বেলা কুয়াশার জন্য বেশ কিছু স্থানে গাড়ি চালানোই কঠিন হয়ে যায়। রাত গভীর হলে কিছু এলাকাতে কিছুই দেখা যায় না।’
রংপুর বিভাগের আবহাওয়া দফতর বলছে, রংপুর অঞ্চলে ৮ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্র ঠিক থাকতে পারে। তবে সর্বনিম্ন তাপমাত্র ক্রমাগত কমবে। অর্থাৎ শীতের তীব্রতা বাড়বে।
লালমনিরহাটের বিভিন্ন হাসপাতাল ও বেশ কিছু কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনই শীতজনিত কাশি, জ্বর, সর্দি, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে শিশু ও বয়স্ক রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মী বেলাল হোসেন বলেন, আমরা ইউনিয়নে বাচ্চাদের টিকা দেই। অসুস্থ বাচ্চাদের টীকা দেওয়া যায় না। এখন গড়ে ১০টা বাচ্চার মধ্যে দুটি বাচ্চা অসুস্থ থাকে। সেই ২টি বাচ্চাকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয় বাজারগুলোতে দেখা যাচ্ছে শীতের আমেজ। পিঠাপুলি সঙ্গে ফুটপাতে বসেছে মৌসুমী শীতের কাপড়ের দোকান। এরমধ্যে পুরনো কাপড়ের দোকানের সংখ্যাই বেশি। এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে ব্লেজার, কোর্ট, কম্বলসহ বিভিন্ন ধরনের মোটা কাপড়।
রংপুর আবহাওয়া দফতরের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে শীত দেখা দিয়েছে। এই শীত ডিসেম্বর আরও বাড়বে। জানুয়ারিতে তাপমাত্রা ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যাবে। তখন কুয়াশা বৃষ্টির মতো পড়তে থাকবে।’
এই শীতের প্রভাব উত্তরাঞ্চলে কৃষিতেও পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি দফতরের কৃষিবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা বর্তমানে তেল জাতীয় ফসলের দিকে নজর দিচ্ছি, যার মধ্যে সরিষা উল্লেখযোগ্য। শীত একটু বাড়লেই সরিষার ক্ষতি হবে। কেউ কেউ আগাম জাতের আলু রোপন করেছেন। যদিও তাদের তেমন ক্ষতি হবে না। রোপা আমনের পরে যদি কেউ সরিষা বোনেন, তাহলে ক্ষতি হতে পারে শেষের দিকে। এছাড়া পেঁয়াজ-রসুনের ক্ষতি হবে। সব ফসলের বিষয়ে সব দিক থেকে কৃষকদের প্রস্তত রাখছি। মাঠে আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, একদিনের ব্যবধানে জেলাটিতে তাপমাত্রা কমেছে ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে জেলায় শীত জেঁকে বসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০ ডিসেম্বরের পরে একটি শৈত্য প্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র এ তথ্য জানিয়েছেন।
সুবল চন্দ্র জানান, শনিবার জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একদিনের ব্যবধানে কমে রবিবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্র ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। ২০ ডিসেম্বরের পরে জেলায় শৈত্য প্রবাহের পূর্বাভাস রয়েছে। তবে আপাতত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই।’
রবিবার সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত কুড়িগ্রামে সূর্যের দেখা মেলেনি। জেলায় কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করছে। আকস্মিক তাপমাত্রা কমায় কর্মজীবী মানুষ বিপাকে পড়েছেন। প্রয়োজন মেটাতে মানুষ শীতের কাপড় মুড়িয়ে বাইরে বের হয়েছেন। কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার নির্মাণশ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আইজ হঠাৎ ঠান্ডা বাড়ছে। দেরিতে কামত বেড়াইছি। জিনিসপত্রের যে দাম, কাম না করলে খামো কী!’
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা সূত্র জানিয়েছে, শীত মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা প্রস্তুত রয়েছে। শীতবস্ত্র হিসেবে জেলার ৯ উপজেলা ও ৩ পৌরসভায় ৩১ হাজার ১৫০ পিচ কম্বল দেওয়া আছে। এখনও প্রায় ১৪ হাজার মজুদ আছে। প্রয়োজনে আরও চাহিদা দেওয়া হবে।