X
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে

গোলাম মওলা
১০ মে ২০২৫, ২৩:৫৯আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ২৩:৫৯

চলমান মূল্যস্ফীতি, ঈদুল ফিতরের খরচ এবং ব্যাংকিং খাতে কিছুটা আস্থার ফিরে আসা— এই তিনটি বাস্তবতায় মার্চ মাসে দেশের অর্থনীতিকে দুই ভিন্ন পথে টেনে নিয়েছে। একদিকে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা আসছে। অপরদিকে মাত্র এক মাসেই ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ চলে গেছে অতিরিক্ত ২৫ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মার্চে ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এটি সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, জনগণ আবারও ব্যাংকিং চ্যানেলের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে, যা দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটে নিমজ্জিত ছিল।

কিন্তু একইসঙ্গে যে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে, তা হলো— ব্যাংকের বাইরে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার প্রবাহ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এক মাসের ব্যবধানে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো নগদ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। এটি অনানুষ্ঠানিক খাতে লেনদেন, কর ফাঁকি এবং আর্থিক খাতে আস্থার ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আমানত প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, গত মার্চ মাসের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ১৮০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮.৫১ শতাংশ বেশি। গত বছরের মার্চে এ পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৭৫০ কোটি টাকা।

এটি ২০২৪ সালের জুনের পর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষে ব্যাংক খাতে বার্ষিক আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭.৪৭ শতাংশ, যেখানে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১ শতাংশ। গত বছরের মাঝামাঝি প্রবৃদ্ধির হার ৯.২৫ শতাংশ থেকে নেমে আগস্টে ৭.০২ শতাংশে পৌঁছায়, যা ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর পেছনে বড় কারণ ছিল দুর্বল ব্যাংকগুলোর অনিয়ম, আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থতা এবং গ্রাহকের আস্থাহীনতা।

কিন্তু আগস্টে দায়িত্ব নেওয়া নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সংস্কার উদ্যোগ আস্থা ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে। তিনি অন্তত ১৩টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, বেনামী ঋণ বন্ধ এবং তারল্য সংকট মোকাবিলায় ‘অর্থ সরবরাহ’ কৌশল গ্রহণ করেন।

পুবালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, মার্চে আমানত প্রবৃদ্ধির পেছনে চারটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত: পলিসি রেট বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলো বেশি সুদ দিতে শুরু করে, যা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেছে। দ্বিতীয়ত: যেসব ব্যাংকের এডিআর বেশি ছিল, তারা নতুন আমানত আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়। তৃতীয়ত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনমূলক পদক্ষেপে গ্রাহকদের আস্থা কিছুটা ফিরে এসেছে। চতুর্থত: মার্চে রেকর্ড ৩.২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে, যার বড় একটি অংশ ব্যাংকে জমা থাকে।

নগদ টাকার প্রবাহে উদ্বেগ

গেলো মার্চ মাসেই অপর একটি বিপরীতচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে— ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার প্রবাহে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চের শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে সাধারণ মানুষের হাতে বা বাজারে চলমান নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে এই পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ।

আগের বছরের মার্চের তুলনায় এই প্রবৃদ্ধি আরও বেশি। ২০২৪ সালের মার্চে ব্যাংকের বাইরে মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়েছে ৩৫ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকিং খাতের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ এভাবে বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। তাদের মতে, এত বিপুল নগদ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে থাকা কর ফাঁকি, অনানুষ্ঠানিক লেনদেন এবং আর্থিক খাতে আস্থার ঘাটতির প্রতিফলন। একইসঙ্গে এতে অর্থের গতি (ভেলোসিটি অব মানি) কমে যায়, যা সামগ্রিকভাবে অর্থ সৃষ্টির হারকে বাধাগ্রস্ত করে। বিপরীতে, এ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ব্যাংকে ফিরে এলে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি উন্নত হতো এবং ঋণ বিতরণের সুযোগ বাড়তো— যা বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারতো।

বিশ্লেষকদের মতে, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটার মৌসুমে নগদ লেনদেন বাড়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখতে আগ্রহী হন। এই কারণেই মার্চ মাসে নগদ টাকার প্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মার্চে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়ার অন্যতম কারণ ছিল ঈদকে কেন্দ্র করে কেনাকাটা। এ সময় সাধারণত মানুষ প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য হাতে অতিরিক্ত নগদ অর্থ রাখতে পছন্দ করেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করা, সুদহারে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা আনা, গ্রাহকসেবার মান বাড়ানো এবং ডিজিটাল লেনদেনের পরিধি প্রসার ঘটানো জরুরি।

তাদের মতে, ব্যাংক খাতের তারল্যই দেশের প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। সেই তারল্য ধরে রাখতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো— আমানত টিকিয়ে রাখা। কারণ, আমানত কমলে ব্যাংকের ঋণ সক্ষমতা কমে যায়, যা উৎপাদন ও বিনিয়োগ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নগদ টাকার ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়লে ডিজিটাল পেমেন্ট, ব্যাংকিং লেনদেন এবং করদাতার সংখ্যা হ্রাস পায়। এতে অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক বা ফরমাল অংশ সংকুচিত হয়। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণ, কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বড় ধরনের বাধা তৈরি হয়।

তাদের পরামর্শ, নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা, মোবাইল ও ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে আরও সহজ, নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় করা এবং একটি কার্যকর নীতিমালার মাধ্যমে ক্যাশ ট্রানজেকশনের প্রবাহ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
মে মাসের শেষে আসছে নতুন নোট
এক ডাকাতের বাড়ি থেকে অস্ত্র-স্বর্ণ ও ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার
ঈদের ছুটিতে অনেক বুথেই টাকা নেই, ভোগান্তিতে গ্রাহক
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (১৫ মে, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১৫ মে, ২০২৫)
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা জবি শিক্ষার্থীদের
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা জবি শিক্ষার্থীদের
তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো দিল্লির জেএনইউ
তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো দিল্লির জেএনইউ
উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ, হাসনাত বললেন ‘প্রত‍্যাশিত নয়’
উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ, হাসনাত বললেন ‘প্রত‍্যাশিত নয়’
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক সেনা সদস্যদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করছে সেনাবাহিনী, ধৈর্য ধরার পরামর্শ
সাবেক সেনা সদস্যদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করছে সেনাবাহিনী, ধৈর্য ধরার পরামর্শ
‘পুলসিরাত’ ইসলামিক নাম, তাই পরিবর্তনের নির্দেশ
‘পুলসিরাত’ ইসলামিক নাম, তাই পরিবর্তনের নির্দেশ
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ
পূজা উদযাপন পরিষদের দুই নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
পূজা উদযাপন পরিষদের দুই নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
আরও ১৬ ভারতীয়কে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে বিএসএফ
আরও ১৬ ভারতীয়কে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে বিএসএফ