মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন রমজান ঘিরে আগেভাগেই বাড়ানো হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। রেহাই পায়নি দেশি-বিদেশি ফলও। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কম বেশি সব ফলের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আর মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে তা কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। ডলারের দাম বৃদ্ধি, শুল্ক বাড়ানো, সরবরাহে ঘাটতি, ঋণ জটিলতা, আমদানি কমসহ নানান অজুহাতে ফলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোক্তারা বলছেন, আমদানিকারকরা ইচ্ছে করে বিদেশি ফল বাজারে কম ছাড়ছেন এবং বাড়তি দামে বিক্রি করে সুবিধা নিচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে রোজা আসার আগেই দাম বাড়ানো হয়েছে ফলের। অন্যদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, ফলের আমদানি কম হচ্ছে। ফলে ব্যবসাও কমেছে। আমদানি বেশি হলে তাদের বেচাবিক্রি বেশি হতো, লাভও হতো বেশি।
আমদানিকারকদের দাবি, ডলারের বাড়তি দাম ও শুল্ক বাড়ায় আমদানি কমার কারণে বাজারে ফলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এজন্য অনেকে মুনাফা কমিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার অনেক আমদানিকারক বড় ক্ষতির শঙ্কায় আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে সব ফলের শুল্ক বাড়ানো হয়নি। দুই-তিনটা ফলের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। গড়ে সব ফলের দাম বাড়ার যৌক্তিকতা নেই। তাদের অভিযোগ, বাজারে তৃতীয় পক্ষ ফলসহ অন্যান্য পণ্য মজুত করে দাম নিয়ন্ত্রণ করছে ও দাম বাড়াচ্ছে। তাছাড়া খুচরা বিক্রেতারা কেনা দামের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করছেন।
বুধবার (১৩ মার্চ) রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফলের আড়ত বাদামতলী এবং সূত্রাপুর, কলতাবাজার, রায়সাহেব বাজার, সদরঘাট ও এর আশপাশের এলাকার খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফল রমজানের আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত। আমদানি ফলের মধ্যে কমলা, মাল্টা, আঙুর ও আপেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিদেশি ফলের বাজার চড়া হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা দেশি ফলের দিকে ঝুঁকেছে। এরইমধ্যে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস, বেল এসবের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি।
বাদামতলীর ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ১৮ কেজির কার্টন আপেল (পোল্যান্ড) ৪৩০০ টাকা ছিল। এখন ৪৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবুজ আপেল প্রতি কার্টন ৪২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২০০ টাকা। রয়েল গালা আপেল ১৮ কেজি ৫৭০০ টাকা। চায়না ফুজি আপেল প্রতি কার্টন সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা হয়েছে। হানি ফুজি আপেল কার্টন ৩ হাজার ছিল, এখন ৩৫০০ টাকা।
মাল্টা প্রতি কার্টন ২৬০০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৪২৫০ টাকা। কালো আঙুর ২০ কেজির প্রতি কার্টন ৪৬০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সবুজ আঙুর ২০ কেজির প্রতি কার্টন ৩৮০০ থেকে বেড়ে এখন ৪৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কমলা ২৪ কেজির প্রতি কার্টন ৩৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৭০০ টাকা হয়েছে। নাশপাতি কার্টনে ২০০ টাকা বেড়েছে। নাগফল ৯ কেজির প্রতি কার্টন ৩০০ টাকা বেড়ে ২৩০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
ফল ব্যবসায়ী মো. জালাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কোনও কারণ ছাড়াই আমদানি করা বিদেশি ফলের ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে ফলের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। বিশেষ করে আগে প্রতিকেজি আপেল, কমলা ও মাল্টায় ৬২ টাকা শুল্ক নিতো। এখন শুল্ক আদায় করছে ৮৮ টাকা। একইভাবে ৯৮ টাকার আঙুরে শুল্কহার ১১৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাউথ আফ্রিকার গালা আপেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি। বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা। চিনা ফুজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। আগে ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা। বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৮০ কেজি, যা ছিল ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। বেড়েছে ১০০ টাকা। কমলা মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা, যা ছিল ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। বেড়েছে ৫০ টাকা।
নাশপাতি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি। বেড়েছে ৪০ টাকার বেশি। মানভেদে সাদা আঙুর বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি, যা ছিল ২১০-২২০ টাকার মধ্যে। বেড়েছে ৬০ টাকা। মানভেদে কালো আঙুরের দাম ছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ছোট ও মাঝারি আনার কেজিতে প্রায় ৮০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা।
এছাড়া দেশি ফলের মধ্যে গত সপ্তাহে যে আনারস বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকায়, আজ সেটি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বড় বেল (বেলি বেল) গত সপ্তাহে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হলেও আজ এটির দাম ২০০ থেকে ২২০ টাকা। অন্য ধরনের বেল যা আগে ছিল ৫০ থেকে ৭০ টাকা, সেটি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। মাসখানেক আগের ১২০ টাকার জাম্বুরা আজ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। স্ট্রবেরি দুদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৩৬০ টাকা কেজি। আজ ৪০০ থেকে কেজিতে খোলা স্ট্রবেরি বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট করা স্ট্রবেরি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এত সপ্তাহ আগে পাকা পেঁপের দাম ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি, আজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। পেয়ারার দাম ছিল ৫০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। তরমুজ গত সপ্তাহে কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৮০ টাকা। এছাড়া সফেদা ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০ টাকায়, সবরি কলার ডজন ৮০-১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সাগর কলা, চম্পা কলার দাম ডজনে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। দেশি কলা সপ্তাহখানেক আগেও একহালি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ বা ৪০ টাকা। এখন এক হালি দেশি কলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা।
বাদামতলী ফলের আড়তদার হাজি আফছার করিম সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. শাওন বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে প্রতিদিন ফলের দাম বেড়েছে। মালটা, নাশপাতি, কমলা, আপেল, আনার ও আঙুর আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। যা ডলারের দামের সঙ্গে ওঠানামা করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ করে ফল আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর ডলার সংকট। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে চায় না ব্যাংকগুলো। সেই সঙ্গে আছে অন্যান্য ভ্যাট ও কর। এতে বিদেশি ফল আমদানি অনেকটা কমেছে। রমজানে চাহিদা বেশি থাকে কিন্তু আমদানি কম হওয়ায় ও শুল্ক বাড়ায় দাম বেড়ে যায়। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে জানান তিনি।
রায়সাহেব বাজার থেকে আধা কেজি আঙুর, আধা কেজি কমলা ও এক কেজি আপেল কিনেছেন আলেয়া বেগম নামে একজন গৃহিণী। তিনি বলেন, দাম বেশি কম তা তো ছেলেমেয়ে বোঝে না। তারা ফল খাওয়ার আবদার করে। তাছাড়া ইফতারিতে যদি দু-একটা ফলের আইটেম না থাকে তাহলে কেমন যেন দেখায়। যত কষ্টই হোক, ছেলেমেয়েদের তো ফলফলাদি খাওয়াতে হয়। ফলের দাম বেশি নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না, কারণ বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। কোনটার কথা বলবো!
রায়সাহেব বাজারের ফল বিক্রেতা রায়হান ব্যাপারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রোজার সময় অন্যান্য দেশে দাম কমে। আর আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। রোজা এলেই পণ্যের দাম বাড়ে। গত কয়েক দিনে সব ধরনের ফলে কেজিতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা দাম বেড়েছে। এ জন্য আমাদের বেচাকেনা কম। বিশেষ করে আপেল, নাশপাতি ও কমলার দাম বেশি বেড়েছে। আড়তে দাম বেশি থাকলে আমরা কী করবো। কিছু ব্যবসায়ী রোজায় মানুষ বেশি কিনবে এমন চিন্তা করে অতি মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে। দাম কম থাকলে আগে যেখানে একজন লোক বিভিন্ন রকমের কয়েক কেজি ফল নিতো, এখন সে দাম বেশি দেখে নিচ্ছে এক বা দুই কেজি ফল। বেশিরভাগ আধা কেজি করেই নেয়।
বিদেশি ফলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগের তুলনায় গত এক মাসে ফল আমদানি অনেক কমেছে। সরকার ফল আমদানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেছে। এতে আমরা ফল আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছি। শুল্ক না কমলে এসব ফলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। শুল্ক কমলে দাম এমনি কমে যাবে। এর মাঝে বাজারে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে ফলের দাম নিয়ে। সেটি শক্ত হস্তে দমন করলে ফলের দাম কমে যাবে।
আরও পড়ুন-
৫০০ টাকার ওপরে কোনও খেজুরই আমদানি হয় না, বাজারে ২ হাজার
পাঁচ বছরে খেজুরের দাম বেড়েছে সাতগুণ
ইসবগুল কেন কেজিতে বাড়লো ৮০০ টাকা
স্বল্পমূল্যের ভ্যানে চাহিদা বেশি ডিম-মাংসের, আগ্রহ কম পাঙাশে