X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছরে খেজুরের দাম বেড়েছে সাতগুণ

আতিক হাসান শুভ
১১ মার্চ ২০২৪, ২০:০০আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪, ২০:০০

পবিত্র রমজানে ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। রমজান এলে বাজারে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। ইফতারে সময় সবাই চেষ্টা করেন খেজুর রাখার। বাজারে জাত ও মানভেদে নির্ধারণ হয় খেজুরের দাম। তবে এবার সব ধরনের খেজুরই বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। দেশের বাজারে খেজুরের দাম নিয়ে চলছে অস্থিরতা। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্রেতাদের মাঝে এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া।

পাঁচ বছর আগেও যেসব খেজুরের দাম ছিল প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, সেসব খেজুরের কেজি এখন ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে এসব খেজুরের দাম কেজিপ্রতি সাত থেকে আটগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে সবচেয়ে কম দামের খেজুর ‘জাহেদি’ জাতের। এই খেজুর প্রতি কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ এই জাতের খেজুরের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। পাঁচ বছর আগে ‘জাহেদি’ খেজুর বিক্রি হতো ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে।

বাজারে ৩০ ধরনের খেজুর পাওয়া যায়, ছবি: নাসিরুল ইসলাম খেজুরের দাম বাড়ার মূল কারণ হিসেবে পুরান ঢাকার বাদামতলীর খেজুর ব্যবসায়ীদের দাবি—ভ্যাট বেড়েছে, তাই খেজুরের দাম বেড়েছে। ভ্যাট যদি কম থাকতো, তাহলে দাম বাড়ার কোনও কারণ ছিল না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর রোজায় যে খেজুর পাইকারি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, সেই খেজুরের ওপরে এবার শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৮ টাকা। এতে পাইকারি বাজারেই খেজুরের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।

নুরুন্নবী তালুকদার নামে একজন খেজুর ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা সবসময় অল্প লাভেই বিক্রি করে থাকি। আমাদের চিন্তা থাকে লাভ অল্প হলেও বিক্রি যদি বেশি হয়, তাহলে লাভ এমনিতে বেশি হবে। আমাদের বিক্রি হয় কেনার ওপর ভিত্তি করে। যেই খেজুর আগে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করতাম, সেখানে এখন ৩৫০ টাকা ভ্যাট দেওয়া লাগতেছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ভ্যাট বাড়ানোর ফলে খেজুরের দাম বেড়েছে। শুধু এ বছরে চার থেকে পাঁচগুণ দাম বেড়েছে শুধু ভ্যাট বাড়ানোর কারণে।’

ব্যবসায়ীরা বলেছেন আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় খেজুরের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, ছবি: নাসিরুল ইসলাম এই বিক্রেতা আরও বলেন, ‘সরকার যদি ভ্যাট কমিয়ে দেয়—তাহলে খেজুরের দাম অটোমেটিক কমে যাবে। জনগণের ভোগান্তি হবে না। এখন সবাই একতরফা ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করছে। আসল ঘটনা তো অন্য জায়গায়। আমরা আমদানি করি, সেটার শুল্ক যদি বেশি দিতে হয়, তাহলে দাম তো বাড়বেই। এটা হচ্ছে মৌসুমি ব্যবসা। ফলে খুচরা বিক্রেতারা যে দামে কেনেন, তার চেয়ে বেশি মুনাফায় খেজুর বিক্রি করছেন।’

খেজুর কিনতে আসা শামসুল হক মাওলানা বলেন, ‘খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। মুসলিম উম্মাহ সবসময় চেষ্টা করে ইফতারে খেজুর রাখার জন্য। খেজুরের পাশাপাশি অন্যান্য ফলও রাখা হয়। খেজুর যেহেতু ইফতারে কমবেশি সবাই খায়, এজন্য একটা সিন্ডিকেট বেশি মুনাফার লোভে খেজুরের দাম যাচ্ছেতাই বাড়াচ্ছে। গতবারের তুলনায় এবার খেজুরের দাম তিন থেকে চারগুণ বেশি বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি অবাক হয়ে গেলাম—ভালো মানের এক কেজি খেজুরের দাম আমার কাছে চাইলো ১৫০০ টাকা। মানুষ কীভাবে ইফতারে খেজুর খাবে, মাথায় আসে না।’

আরেক ক্রেতা আমির হোসেন বলেন, ‘খেজুর দিয়ে ইফতার না করলে যে ইফতার হবে না—বিষয়টা তো এমন না। বাঙালির একটা প্রবণতা হচ্ছে, যে জিনিসের দাম বাড়ে, সেটার প্রতি তাদের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তারা সেই পণ্য আরও বেশি করে কেনে। রোজা এলে একদল চিন্তা করে কীভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। অথচ রোজার ফজিলতের কথা চিন্তা করে সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশে জিনিসপত্রের দাম কমায়। সেখানে বাংলাদেশের চিত্র একেবারে উল্টো। এক্ষেত্রে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ একেবারে নিরুপায়। দাম বাড়লেও আমাদের কিনতে হবে, কমলেও কিনতে হবে। শুধু যে খেজুরের দাম বাড়ছে বিষয়টা কিন্তু তা না, কমবেশি সব জিনিসের দাম বেড়েছে।’

 দাম কম হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জাহেদি খেজুর, ছবি: নাসিরুল ইসলাম জাত ও মানভেদে খেজুরের দাম

রাজধানীর বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাত ও আকার অনুযায়ী দেশে কমপক্ষে ৩০ ধরনের খেজুর বিক্রি হয়। এর মধ্যে দাম কম হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ‘জাহেদি’ ও বস্তায় আসা খেজুর। এটি আসে ইরাক থেকে।‌ এছাড়া আজোয়া, মরিয়ম, মাসরুক, ডালা-আলজেরিয়া, নাঘাল, সায়ের, মডজুল, ‌কালমি, ফেনছি, ইরান ও জর্ডানের মরিয়ম, লাকজারি, সুগাই, তিউনিসিয়া থাল, সুফকারি, জাম্বু, মাবরুম, দাব্বাস, জাহেদি, রেজিজ, আমিরাতের লুলু ও বারহি—বাজারে এসব খেজুরের চাহিদা রয়েছে।

দেশের বাজারে প্রতি কেজি মারিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, মাবরুম ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, মেডজুল ১৩০০ থেকে  ১৪০০ টাকা, দাবাস ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। আজোয়া মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা কেজি। আজোয়া এবং মরিয়ম ক্ষেত্র বিশেষে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আরও বেশি দামের খেজুরও আছে। তবে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে জাহেদি খেজুর, দাম প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। গত বছরের তুলনায় পাইকারি বাজারে সব ধরনের খেজুরের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে। দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে কেজিতে আরও ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

খুচরা খেজুর বিক্রেতা মো. রিহান জানান, পাইকারি বাজার থেকে আমরা যে দামে কিনি, খুচরা পর্যায়ে কেজিতে তার চেয়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভ করি। তবে আজোয়া এবং মরিয়ম খেজুরের ক্ষেত্রে একটু বেশি। কারণ, অনেক টাকা চালান খাটাতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের খরচ আছে। এখন দাম বাড়ার কারণে খেজুরের বিক্রিও কমে গেছে। আগে যে মানুষ একসঙ্গে ৫ কেজি খেজুর কিনতেন, এখন তারা এক বা ২ কেজি কিনেন। পাইকারি বাজারে যদি কম দামে কিনতে পারতাম, তাহলে খুচরাও কম দামে বিক্রি করতে পারতাম।

খেজুরে মাছি, পোকা বা পিঁপড়া  থাকলে বুঝতে হবে— তা  মেয়াদোত্তীর্ণ বা কৃত্রিমভাবে মিষ্টি মেশানো হয়েছে, ছবি: নাসিরুল ইসলাম ভালো খেজুর চেনার উপায়

ছোট-বড় সবাই কমবেশি খেজুর খেতে পছন্দ করেন। খেজুর একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। খেজুরের রয়েছে অনেক উপকারিতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাসে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল খেজুরও বিক্রি করেন। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী চীনা ফল ‘জুজুবি’কে খেজুর বলে বিক্রি করেন। এ জন্য আসল খেজুর চেনা জরুরি।

ভালো খেজুর চেনা কঠিন বলে মন্তব্য করেন বাদামতলীর ব্যবসায়ী শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘অনেক ব্যবসায়ী সব খেজুরই সৌদি আরবের বলে বিক্রি করেন। এটা ঠিক না। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে খেজুর আসে। সৌদির খেজুরের চেয়ে সেগুলোর দাম কিছুটা কম। আবার দামে অনেক কম হলেও দেখতে কাছাকাছি হওয়ায় অনেকে ‘কালমি’ খেজুরকে ‘মরিয়ম’ নামে বিক্রি করে। অথচ মাবরুম, মাশরুক, আজওয়ার মতো কালমিও সৌদি আরবের খেজুর। আর মরিয়ম হচ্ছে ইরানের খেজুর, যা দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসে।

সব খেজুর সৌদি আরবের বলে বিক্রি করা হলেও তা সঠিক নয়, ইরাক ও ইরান থেকে বাংলাদেশে খেজুর আসে, ছবি: নাসিরুল ইসলাম গবেষকরা বলছেন—মাছি, পোকা বা পিঁপড়া থাকা খেজুর কেনা যাবে না। এগুলো থাকলে বুঝতে হবে— ওই খেজুর মেয়াদোত্তীর্ণ বা কৃত্রিম মিষ্টি মেশানো হয়েছে। ভালো খেজুরের চামড়া কুঁচকানো হয়। ভালো খেজুর চেনার উপায় সম্পর্কে গবেষক ও চিকিৎসক অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী বলেন, ‘খেজুর কিনতে হবে উপরিভাগ কুঁচকানো দেখে। ভালো মানের খেজুরের বহির্ভাগ খুব একটা মসৃণ ও টানটান হবে না। খেজুর খুব বেশি মিষ্টি হলে বুঝতে হবে—এতে কৃত্রিম মিষ্টি মেশানো হয়েছে। খেজুর সাধারণত দেড় বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। যত পুরনো হবে, খেজুরের ভেতরটা তত লালচে হবে। ভেতরটা যদি সাদা হয়, তাহলে বুঝতে হবে খেজুরটা ভালো। খেজুর তেলতেলে হলে বা পাউডার জাতীয় কিছু থাকলে বুঝতে হবে—এতে কিছু মেশানো হয়েছে। এসব খেজুর না কেনাই ভালো।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
আজ ঈদ
ঈদুল ফিতরে করণীয়
চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
সর্বশেষ খবর
মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ অব্যাহতমার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়
বালুবাহী বলগেট থেকে নদীতে পড়ে শ্রমিক নিখোঁজ
বালুবাহী বলগেট থেকে নদীতে পড়ে শ্রমিক নিখোঁজ
পিনাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পিনাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে বান্দরবানে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ
৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে বান্দরবানে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ
সর্বাধিক পঠিত
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে