X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

গুড নিউজ কবে ‘গুড নিউজ’ হবে?

রেজানুর রহমান
২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৭আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:১১

প্রচার মাধ্যমের ক্ষেত্রে ‘ব্যাড নিউজ’ই ‘গুড নিউজ’। খারাপ খবরই ভালো খবর। মূলত পাঠকের আগ্রহের কারণে প্রচার মাধ্যমে খারাপ খবরেরই গুরুত্ব বেশি। হত্যা, গুম, কালোবাজারি, অপহরণ, দুর্নীতি, স্ক্যান্ডাল, পরকীয়ার সত্যমিথ্যা সংবাদ যেভাবে প্রচার মাধ্যমে গুরুত্ব পায় উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা, সাফল্য, দৃষ্টান্ত, পরোপকার, আত্মত্যাগের খবর সেভাবে গুরুত্ব পায় না। একটি পরিবারের কথা বলি। ছেলে মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। বাবা-মায়ের ইচ্ছে মেধাবী মুখ হিসেবে ছেলের সাফল্যের খবর কোনও পত্রিকায় ছাপা হোক। বাবা সেই চেষ্টাও করেছিলেন। কোনও পত্রিকাই তার কথা শোনেনি। একদিন ওই ছেলেকেই পাশের বাড়ির একজন ডাক সাইটে ব্যক্তি উদ্দেশ্য প্রবণ হয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়। ব্যস, এবার আর তার বাবাকে পত্রিকার অফিসে অফিসে ধর্না দিতে হয়নি। অপহরণ মামলার আসামি হিসেবে একাধিক পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। বাবা এতদিন ছেলের ছবি পত্রিকায় দেখার জন্য কি চেষ্টাটাই না করেছেন। অথচ ছেলের ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর লজ্জা, অপমানে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।

ব্যাড নিউজের এমনই শক্তি। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ প্রচার মাধ্যম সমূহে ব্যাড নিউজেরই আধিপত্য।

আমাদের সিনেমার কথাই বলি। আমাদের সিনেমা নিয়ে কতই না নেতিবাচক কথাবার্তা। হতাশার খবর। আমাদের নাকি কিছুই হয় না। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল পত্রিকায় সপ্তাহের সেরা সিনেমার নাম প্রচার ও প্রকাশের উদ্যোগ আছে। যাকে বলা হয় টপচার্ট। এই টপচার্টে সাধারণত বাংলাদেশের কোনও সিনেমার নাম থাকে না। অনেকে হয়তো বলবেন বাংলাদেশের সিনেমার নাম থাকবে কী করে? বাংলাদেশে তো আগের মতো সিনেমা নির্মাণ হয় না। যারা এসব কথা বলেন তারা না জেনে না বুঝে বলেন। বলতে হয় বলেই বলেন। এক ধরনের উন্নাসিকতা। পাশের ফ্লাটের ভাবী বেশ সুন্দরী। যেমন রুপ তেমনই গুণ। কথায় কথায় তার রুপ ও গুণের প্রশংসা। অথচ নিজের স্ত্রী চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিদিন সংসারটাকে বয়ে নিয়ে যায়। সেদিকে কোনও খেয়ালই থাকে না। যারা বলেন, দেশে ভালো সিনেমা হচ্ছে না তারা সত্যিকার অর্থেই ভুল বলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একাধিক ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ভালো সিনেমার ভালো খবর সেই অর্থে প্রচার মাধ্যমে দেখিনি।

একটা বড় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হলো অতি সম্প্রতি। এ নিয়ে প্রচার মাধ্যম সমূহে খুব যে একটা প্রচার দেখেছি তা নয়। দেশে প্রথমবারের মতো মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে একটি পুরস্কার চালু হয়েছে। প্রয়াত নাট্যকর্মী ইশরাত নিশাতের নামে দেশ নাটক প্রবর্তিত এই পুরস্কারকে মঞ্চ নাটকের অস্কার বলেই গুণীজনদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। অথচ প্রচার মাধ্যমে এই শুভ উদ্যোগটি তেমনভাবে গুরুত্ব পেয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। অনেক পত্রিকায় প্রেস রিলিজ নির্ভর দায়সারা সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমার ধারণা অনেকেই এই পুরস্কারের গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। তবে আমার ধারণা ওই পুরস্কার মঞ্চে নেতিবাচক কোনও ঘটনা ঘটলে মঞ্চ নাটকের এই পুরস্কারটি বেশ আলোচিত হতো।

প্রসঙ্গক্রমে আমাদের চিত্র নায়িকা পরীমণি ও চিত্রনায়ক শরীফুল রাজের কথা একটু বলি। পরীমণি ও শরীফুল রাজ অভিনীত কোনও সিনেমার ভালো-মন্দ রিভিউ কি কোথাও দেখেছি আমরা? হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও না কোথাও ছাপা হয়েছে। কারও চোখে পড়েছে। কারো চোখে পড়েনি। তবে সিনেমার আলোচনায় না এলেও পরীমণি ও শরীফুল রাজ ব্যক্তিগত জীবনের আলোচনায় আছেন সবার থেকে শীর্ষে। আমার ধারণা তারা দু’জনই বুঝে ফেলেছেন প্রচার মাধ্যমে কীভাবে সরব থাকতে হয়। বোধকরি সে জন্যই নিজেরাই মাঝে মাঝে সংবাদ তৈরি করেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিয়ে, সংসার টিকবে কী টিকবে না এই নিয়ে প্রচার মাধ্যম সমূহে কি ঝড়টাই না বয়ে গেলো। অবস্থাটা এমন যে, পরীমণি আর রাজের সংসার টেকা না টেকার ওপর আমাদের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বেশ কিছু প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে পত্রিকায় এমন খবরও পড়তে হলো যাতে মনে হয়েছে পরী আর রাজের বিবাহ বিচ্ছেদ সময়ের ব্যাপার মাত্র। চূড়ান্ত ঘোষণা আসার পর-পরই বেশ বড় করে নিউজ করার অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো অনেকে। আমার ধারণা পরী আর শরীফুল রাজ নিজেরাও এমনটাই চেয়েছিলেন। প্রচার মাধ্যমের ফোকাসটা তাদের ওপর থাকুক। এক সময় নতুন খবর জানিয়ে দেবেন। সেটা আরও চমকপ্রদ হবে। তাই ঘটলো। হঠাৎ একদিন পরী আর শরীফুল রাজ সুখি দম্পতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমরা পরস্পরকে অনেক ভালোবাসি। প্রচার মাধ্যমে আবার শিরোনাম হলেন পরী আর শরীফুল রাজ। ভিডিওতে দু’জনের এই আবেগঘন সংলাপ ও ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গণ দেখে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা নিয়ে সত্যিকার অর্থে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি এখনও। তবে এটা সত্য, পরী ও রাজ আমাদের প্রচার মাধ্যমের ভাবগতি ধরতে পেরেছেন। বোধকরি তারা বুঝতে পেরেছেন ব্যাড নিউজই যেহেতু গুড নিউজ কাজেই ব্যাড নিউজের মধ্যেই থাকা ভালো। কেউ তো খারাপ কিছু বলে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইক আর কমেন্টের হিড়িক পড়ে যায়।

ব্যাড নিউজই গুড নিউজ। এটাই সত্য। তাই বলে গুড নিউজ কি গুড নিউজের তালিকায় থাকবে না।

কয়েকদিন আগে কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বিষয়ক একটি গবেষণার তথ্য প্রচার মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে। এই গবেষণার তথ্য বেশ উদ্বেগজনক। সামান্য কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে। বাবা-মা বকেছেন, তাই ছেলে অথবা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। অসতর্কতাবশত কোনও মেয়ের ব্যক্তিগত ছবি বন্ধুর কাছে চলে যায়। সেটা নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ ফেলে বন্ধু। শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। একদিন জোর করে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে তোলে। লজ্জায়, অপমানে মেয়েটি হয়তো আত্মহত্যা করে।

বন্ধুর হাতে দামী মোবাইল ফোন। কাজেই আমারও দামী মোবাইল ফোন দরকার। বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে যখন পাওয়া গেলো না তখন কেউ কেউ আত্মহত্যার কথা বেছে নিচ্ছে। মোদ্দাকথা, বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা অন্যকে বলতে না পারা, মান-অভিমান, নিজের অজান্তে ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি, শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে অশোভন আচরণ পাওয়া, মোবাইলে গেম খেলতে বাধা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা সহ নানা কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। এক্ষেত্রে কিশোর অর্থাৎ স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। পড়াশোনা শেষ। চাকরির নিশ্চয়তা নেই। বেকার জীবনের পাহাড় সমান অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। গত বছর সারাদেশে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাজনিত কারণে করুণ মৃত্যু হয়েছে।

এখন কথা হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই যে এত আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে তা রোধ করার উপায় কী? ওই গবেষণায় তারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। গবেষণার সুপারিশে কিশোর তরুণদের মাঝে হতাশা দূর করার পদক্ষেপ হিসেবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের ভূমিকার প্রতিও অধিক গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে কিশোর তরুণদের মাঝে সুন্দর ভবিষ্যতের একটি চিত্র থাকা দরকার। ভালো কাজের ভালো পুরস্কার থাকা জরুরি। একজন সন্ত্রাসীকে আমরা অনেকেই বাধ্য হয়ে গুরুত্ব দেই। প্রচার মাধ্যমে তাকে গুরুত্ব দিতে কার্পন্য করি না। কিন্তু একজন মেধাবী শিক্ষার্থী শুধু প্রচার মাধ্যম নয় সমাজের অন্য কোথাও তেমন গুরুত্ব পায় না। অথচ একজন সন্ত্রাসীর চেয়ে একজন মেধাবী তরুণ-তরুণীর গুরুত্ব বেশি হওয়া উচিত। কিশোর-তরুণদেরকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে ওই গবেষণায়। অথচ আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরই কোনও সম্মান, গুরুত্ব নেই। আমরা অনেকেই অন্যের ছেলে-মেয়ের গান, অভিনয়ের প্রশংসা করি। কিন্তু নিজের সন্তানকে ওই পথে যেতে দিতে চাই না। কী হবে নাটক, গান বাজনা করে? এমন ভাবনা দেশের অধিকাংশ অভিভাবকের। সবাই চায় তার ছেলে অথবা মেয়েই সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হোক। অথচ আদৌ সেটি সম্ভব নয়। সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার চেয়ে ছেলে মেয়েরা সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা সেটাই বোধকরি প্রত্যেক অভিভাবকের বিবেচ্য হওয়া সময়ের দাবি।

আত্মহত্যা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। ঠুনকো কারণেই গত বছর ছাত্র ছাত্রীদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকার পাশাপাশি অভিভাকদেরও কী দায় থাকার কথা নয়। অভিভাবকদের উদ্দেশে বলি, আপনি কি আদৌ জানেন আপনার প্রিয় সন্তান প্রতিদিন কোথায় যায় কার সাথে মিশে তার বন্ধু কারা? বিশেষ অনুরোধ খোঁজ রাখুন। আর প্রচার মাধ্যমকে অনুরোধ করি– ব্যাড নিউজই গুড নিউজ এটাই বাস্তবতা। তাই বলে গুড নিউজ যেন চাপা পড়ে না যায়। কেউ ভাববেন না আমি জ্ঞান দিচ্ছি। দুঃখিত, কাউকে জ্ঞান দেবার যোগ্যতা আমার নেই। এটি একটি অনুরোধ। শুভ কামনা সবার জন্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো। 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ বাংলাদেশিকে সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারে অপহরণ
১০ বাংলাদেশিকে সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারে অপহরণ
তিন মামলায় মিল্টনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
তিন মামলায় মিল্টনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ভারতের ভোটে বিজেপির পক্ষে কি ‘৪০০ পেরোনো’ আদৌ সম্ভব?  
ভারতের ভোটে বিজেপির পক্ষে কি ‘৪০০ পেরোনো’ আদৌ সম্ভব?  
বিশ্বকাপ দল নিয়ে লুকোচুরি কেন?
বিশ্বকাপ দল নিয়ে লুকোচুরি কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ