X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

গাছ কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ কার স্বার্থে?

জোবাইদা নাসরীন
১৫ মে ২০২৩, ১৯:২১আপডেট : ১৫ মে ২০২৩, ১৯:২১

পৃথিবীর অনেক দেশেই লেখাপড়া করেছি এবং বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। সেই সূত্রে বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক স্থাপনা এবং পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আমি সর্বশেষ যে শহরে থেকেছি সেটি ১৮ শতকের শহর। সেটিকে সেভাবেই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি সেখানের গাছপালাকেও। এমনকি কয়েকটি দালানের নকশা একটু বাঁকা দেখে অবাক হয়ে দেখলাম কয়েকটি গাছকে রক্ষা করার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। এমনকি ছাদের মধ্যে গোলাকৃতি অংশ রাখা হয়েছে গাছকে রক্ষা করার জন্য।

অথচ আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই গাছ রক্ষার আন্দোলন করতে হয়। প্রতিবছরই আমাদের ঘাম ঝরাতে হয়, চিৎকার করতে হয়, রাস্তায় নামতে হয়। কিন্তু তাতে যে গাছকে রক্ষা করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। বর্তমানে ধানমন্ডির সাতমসজিদ  রোডে ‘গাছ কাটা নিষেধ- আদেশক্রমে নগরবাসী’– এই ধরনের পোস্টার এবং ফেস্টুন নিয়েই চলছে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন। বেশ কয়েক মাস ধরেই ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডে গাছ কাটার বিপরীতে এভাবেই প্রতিবাদ তৈরি করেছেন এলাকাবাসী। পোস্টারের এই ভাষা নিছক কোনও বিষয় নয়, আমাদের অনেক কিছু জানান দেয়। আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কোনও দাম নেই, তারা শুধু নিজেদের পরিকল্পনাই চাপাতে জানে।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই এলাকায় গাছ সৌন্দর্যবর্ধন এবং গাছ কাটার পরিকল্পনা দক্ষিণ সিটি অনেক দিন থেকেই করছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন  সড়কদ্বীপ, ফুটপাত, সড়ক বিভাজকের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধানমন্ডির  সাতমসজিদ সড়কের সড়ক বিভাজকের উন্নয়ন এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে।

ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক বিভাজকসহ সব বিভাজকে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে করেছেন  সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলন। গণমাধ্যমকে  জানিয়েছেন– ইতোমধ্যে সড়ক বিভাজকটির প্রায় ৬০০ গাছ কাটা হয়েছে। এখন ৩০ থেকে ৪০টি গাছ আছে। বন বিভাগের বিধিমালায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি জমির গাছ কাটার আগে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। এখানে তা অনুসরণ করা হয়নি।’

তবে সংবাদমাধ্যমগুলো এই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের অবস্থান তুলে ধরেছে। তার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে এভাবে, ‘অন্য উপায় না থাকায়’ উন্নয়ন কাজের জন্য এই গাছ কাটতে হচ্ছে। আর যত গাছ কাটা হবে, তার তিনগুণ লাগানো হবে। …উন্নয়ন কাজগুলো বাস্তবায়নের সময় নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকাকে অবশ্যই আমরা একটি সুন্দর, সবুজ নগরীতে পরিণত করবো।”

এখানে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত কার উন্নয়ন? উত্তর নিশ্চিতভাবেই আসবে মানুষের স্বার্থে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বেশিরভাগ মানুষকে জানতে দেওয়া হয় না এই উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য কী? এবং সেই উন্নয়ন মানুষ চায় কিনা? জনস্বার্থে উন্নয়ন আসলে কার স্বার্থে?

তার পরের প্রশ্নটি ‘সৌন্দর্যবর্ধনের সংজ্ঞায়। এই সৌন্দর্যবর্ধন কার দৃষ্টিভঙ্গিতে হচ্ছে? জনগণ আসলে এই সৌন্দর্যবর্ধন চাচ্ছে কিনা? গাছ রেখে কি এই সৌন্দর্য ধরে রাখা যেত না? নাকি এই গাছ রেখে এতদিন এই এলাকাটি এবং রাস্তাগুলো সুন্দর দেখা যায়নি। মেয়র বলেছেন– এই গাছ কাটার পরে সেখানে তিনগুণ গাছ লাগানো হবে। কী কী গাছ সেখানে লাগানো হবে? এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কেটে সেখানে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাসসহ নানা ধরনের পরিবেশ ধ্বংসকারী গাছ। এখানেও এই সাইজের একই রকম গাছ লাগিয়ে রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। মেয়র বলেছেন– এই প্রক্রিয়ায় তিন জন পরিকল্পনাবিদ যুক্ত আছেন। এই পরিকল্পনাবিদ কারা? কাদের সঙ্গে আলাপ করে এই পরিকল্পনা করা হচ্ছে?

যেকোনও কিছু করার আগে এলাকার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলাপ করার নিয়ম। কিন্তু সেগুলোকে কোনোভাবেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যে নগর পরিকল্পনাবিদরা এই সৌন্দর্যবর্ধনের মানচিত্র তৈরি করেছেন তারা কি আসলে জনগণের চিন্তার প্রতি মনোযোগী হতে চাচ্ছেন না?

জনগণের দাবি মেনে নেওয়াই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। কিন্তু কেন আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম হয়? আমরা দেখি এ দেশে জনগণের চাওয়ার কোনও মূল্য নেই। এই প্রথম যে গাছ কাটা হচ্ছে তা নয়। গত তিন দশকে গাছ বাঁচানোর আন্দোলন শুধু ঢাকাতেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেই হয়েছে। ঢাকার ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী, রমনা পার্কে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন কম হয়নি। দেখা গেছে আন্দোলন হলে কিছু দিন গাছ কাটা বন্ধ থাকে। কিন্তু এরপর নানা কৌশল, জাতীয় স্বার্থের হাওয়া তুলে চলতে থাকে গাছ কাটা। গত জানুয়ারি থেকে ‘সৌন্দর্যবর্ধনের’  নামে বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরিষসহ অনেক গাছ কাটা হয়েছে। জানুয়ারি মাসেই এর বিরুদ্ধে প্রথম মানববন্ধন করা হলে কিছু দিন গাছ কাটা বন্ধ ছিল। এবারের আন্দোলনের মুখে গত ৩০ এপ্রিল থেকে গাছ কাটছে রাতের অন্ধকারে।

এখনও আন্দোলন চলছে। গাছ কাটার নির্দেশের পাশাপাশি এলাকাবাসীও নির্দেশ দিয়েছেন গাছ না কাটার জন্য। আপাতত মনে হবে এটি একটি কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। মানুষের জন্য গাছ যে কতটা জরুরি সেটি আমাদের মনে রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি।

মাননীয় মেয়র, যত গাছ কাটা হয়েছে তার তিনগুণ গাছ লাগানো হবে, এটি আসলে কোনও ফয়সালা নয়। কী গাছ লাগানো হবে, সেটি আগের গাছগুলোর মতোই পরিবেশ রক্ষা করবে কিনা? অক্সিজেনের ভাণ্ডার হবে কিনা? এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর জনগণ না চাইলে সেটি কেন করবেন সেই বিষয়েও বারবার ভাবতে হবে? কারণ, আপনি জনপ্রতিনিধি। আপনাকে জনগণের কথা শুনতেই হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com

 
 


/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ