X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এডিস মশা থাকলে ডেঙ্গু থাকবেই, তাই মশা মারুক কর্তাব্যক্তিরা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৬ জুলাই ২০২৩, ১৬:১৪আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২৩, ১৬:১৪

২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন যৌথ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই শহরের মেয়ররা কথা বলেছিলেন। কারণ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভারতের অন্য সব শহরের চেয়ে কলকাতা এগিয়েছিল। তখন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় ঢাকার পাশে কলকাতা’।

ঢাকা শিখতে চেয়েছিল, কিন্তু শিখেনি। এখন কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে আর আমরা মহামারিতে আক্রান্ত। ঢাকাসহ দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমাদের সবার জানা। এডিস মশা ও ডেঙ্গু এক বড় আতঙ্কের নাম। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে মানুষ। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে রোগীর চাপে। ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মশা যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই ডিম পাড়ছে। প্রতিকূল পরিবেশে এসব ডিম সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে দীর্ঘদিন। যখনই বৃষ্টির পানি জমতে শুরু করছে, তখনই ডিম থেকে বেরিয়ে আসছে মশা।

এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে যা দরকার ছিল তা হলো সম্ভাব্য ডেঙ্গুর প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষসহ সারা দেশেই সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো এই এক কাজে ব্যর্থ হয়েছে। মশা কোনোভাবেই মারতে পারছে না। দুই সিটি করপোরেশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি মশক নিধনের জন্য যে ওষুধ আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলো অকার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

ডেঙ্গু প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিস্তার করে, এটা কর্তৃপক্ষ জানে। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর বিস্তার একটু আগেভাগেই এসেছে এবং প্রকোপও বেশি। প্রশ্ন হলো, যা আগে থেকেই জানা, সেটি মোকাবিলা করতে পারছে না কেন সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়? কারণ, কেউই সিরিয়াস ছিল না।

কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানী, তার মেয়রসহ অন্যরা শহরকে ডেঙ্গুমুক্ত রাখতে পারলে একটা দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার মেয়ররা কেন ব্যর্থ? এই আলোচনা বড় আকারে হওয়া প্রয়োজন। কলকাতা সাফল্য পেয়েছে, কারণ এ কাজে তারা মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো– কলকাতা বুঝতে পেরেছে ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটিয়ে দিলে মশা মরে না এবং ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণে আসে না। ফগার দিয়ে মশাকে ধাওয়া করলে এক স্থানের মশা আরেক স্থানে চলে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। উৎপত্তিস্থলে মশা নির্মূল করেই কলকাতা সফল হয়েছে।

গত কয়েক বছরে ডেঙ্গু ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও মশার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। ফলে এই মৌসুমে এটি মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতির দিকে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বেড়েছে, কিন্তু সারা বছরই, এমনকি শীতকালেও ডেঙ্গু রোগী কিছু কিছু করে হাসপাতালে আসছিল।

যেকোনও পরিস্থিতিতে আমাদের শাসকরা মানুষকে সচেতন হতে বলেন। এটা অনেকটা ভিকটিম ব্লেমিংয়ের মতো। মানুষকে তার চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো সবই ঠিক আছে। কিন্তু মশা তো মারতে হবে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাকেই। সেই কাজে কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে তার জবাবদিহি কোথায়?

কলকাতা প্রথমেই যেটা করেছে সেটা হলো, তারা মৌসুমের অপেক্ষা না করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে সারা বছরের কাজ হিসেবে দেখেছে এবং কাজ করেছে। সেখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তিন স্তরের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০ সালের দিকে এসব কাজ শুরু হয়। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণাগার গড়ে তোলা হয় যেন ডেঙ্গুর গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়। ২০১১ সালে মাত্র চার লাখ টাকায় সেই গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছিল। গবেষণাগারে কেবল দেখা হতো, লার্ভা থেকে কীভাবে মশা বেড়ে উঠছে। মশককর্মীদেরও এটা দেখানো হতো। তিন হাজার মাঠকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। চোখের সামনে তাদের মশার চরিত্র দেখানো হয়েছিল।

সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চিকিৎসক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা আছেন। আমাদের রাজধানীতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দেখা পাওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কাউন্সিলররা পুরোপুরি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সক্রিয় না হলে একা মেয়র মহোদয় যতই দৌড়ঝাঁপ করুন না কেন লাভ হবে না। কলকাতায় প্রতি ওয়ার্ডে ৬ থেকে ১৫ জন মশককর্মী থাকেন এবং এদের প্রত্যেক কর্মীর মশা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ আছে। এসব ওয়ার্ড কমিটির কাছে এলাকার সম্ভাব্য ডেঙ্গুর উৎসস্থলের তালিকাও আছে।

আমাদের সিটি করপোরেশন বলতে পারবে কোন এলাকায় কয়টি ডোবা আছে? কয়টি এডিস মশার উপযোগী স্থান আছে? কলকাতায় এই ডাটাবেজটি আছে। ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, আছে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। 

সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান দুটি কাজ– মশা মারা ও ময়লা পরিষ্কার করা। এই দুই কাজে, বিশেষ করে মশা মারায় চরমভাবে ব্যর্থ। মেয়ররা হয়তো আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন যে তারা কাজ করছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনসহ পৌরসভাগুলো মশা মারতে যে ওষুধ ছিটিয়ে থাকে, তার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। মশা মারার ওষুধ কেনাকাটা, সেগুলো ছিটানোসহ গোটা কার্যক্রমে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয় বহুল আলোচিত। মশার আগ্রাসন যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য সেটা প্রমাণ করেছে কলকাতা। সমস্যা হলো কিছুই শিখছে না সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্টরা। অনেক মানুষ মরছে, কিন্তু এসব কর্তৃপক্ষের কাছে তারা কেবলই সংখ্যা।

ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানীর সমস্যা নয়, সারা দেশের সমস্যা। মৃত্যুর রেকর্ডও হয়ে গেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের তেমন জোরালো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কোনও পরিকল্পনা নেই। এই মশা থাকলেই রোগী থাকবে, এই সত্য মেনেই মানুষকে বাঁচাতে উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ