X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফলমূল, আহার, রাজনীতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০২ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৫১আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৫১

সম্প্রতি ঢাকার প্রবেশপথসমূহে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে আহত হওয়া দুই নেতা, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। গত শনিবার কর্মসূচিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন আমানউল্লাহ আমান। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে আমানের খোঁজ-খবর নেন এবং একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে খাবার ও ফল পাঠান। অন্যদিকে একই দিন হঠাৎ উড়ে আসা এক ঢিলে মাথায় আঘাত পাওয়ার গয়েশ্বরকে নিরাপদে গোয়েন্দা অফিসে নেয় পুলিশ এবং তার চিকিৎসা ও পরিচর্যা করে। পরে তাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করা হয়, যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। এই দুই ঘটনা এখন বিএনপির ভেতরে বাইরে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে দেখলে দুটি ঘটনাই চমৎকার শিষ্টাচারের দৃষ্টান্ত। রাজনীতি মানেই আদর্শগত পার্থক্য থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়েও বিদ্বেষ বিভাজন লালন করতে হবে সেটা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু আমাদের এখানে এগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে ব্যঙ্গবিদ্রূপ চলছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তহীন দুর্নীতি আর ক্রমবর্ধমান অন্যায়প্রবণতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা পুলিশ কর্তাদের এই নতুন প্রথার সম্পর্ক দেখা কঠিন। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির ওপর রাজনীতি যখন নির্ভরশীল হয়, তখন সবাই সেটা দেখাতেই অভ্যস্ত হয়। সৌজন্যবোধও যে দেখানো যায় সেটা আমরা ভুলে যাই।

বাংলাদেশের রাজনীতির পরিসরে সৌজন্য অতি স্বাভাবিক এবং সুলভ– এ কথা কেউ বলবে না। নির্বাচনি মৌসুম না-হয় গ্যালারি মাতাবার জন্য নির্ধারিত, কিন্তু সাধারণ পরিস্থিতিতেও অনেক সময়েই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আচরণগত অসৌজন্যে পর্যবসিত হয়ে থাকে। অথচ গণতন্ত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রকাশের স্বীকৃত ও অবাধ মঞ্চ সরবরাহ করে বলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিকদের সামাজিক আচরণে পারস্পরিক সৌজন্য প্রকাশের যুক্তি ও অবকাশ দুই-ই অধিক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য শিষ্টাচার আগেও দেখিয়েছেন। নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর শুনে বেগম জিয়ার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন দেশবাসী বিস্ময়ে দেখেছেন যে দরজা খোলা হয়নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী দরজা থেকে ফেরত এসেছেন।

আমাদের রাজনীতির মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর দ্বন্দ্ব। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতো ঘটনা অতি স্বাভাবিক। আমরা যদি অতীতের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রতিপক্ষের প্রতি কোনও অসৌজন্য আচরণ করেননি। বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন আজীবন এমন রাজনীতিকরাও প্রশংসা করে বলেছেন, কখনও অসৌজন্য আচরণ করেননি শেখ মুজিবুর রহমান।

রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ রাজনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতার জন্যই প্রয়োজন। তবে আমাদের রাজনীতিবিদদের অসহনশীল আচরণ, অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ রাজনীতির মাঠকে অসুস্থ করে তুলেছে।

২০১৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৭-২৮-২৯ অক্টোবর ঢাকায় ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের জন্যে যোগাযোগের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। তবে সময় পেরোনোর আগেই ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেত্রীর ফোনালাপ চলে ৩৭ মিনিট ধরে। সেই ফোনালাপ সেদিন রাতেই নেটে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণটা প্রচার করে। আর ২৮ তারিখ প্রায় সব পত্রিকাতেই আলাপের পুরোটাই ছাপে। শেখ হাসিনার একের পর এক আহ্বানে, আপস প্রস্তাবে অভিযোগের বাণে লাগাতার চাপে রাখতে গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনে অনেক এগিয়ে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয় বিএনপিকে ছাড়াই এবং বিএনপি-জামায়াতের সহিংস নির্বাচন প্রতিহতের মধ্যেই সেটি অনুষ্ঠিত হয়।

আমানউল্লাহ আমানের প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে নীতি ও সৌজন্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, কিংবা গোয়েন্দা দফতরে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন গয়েশ্বর রায়কে যে আপ্যায়ন করেছেন তা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারছি না। একদল এ নিয়ে ট্রল করছে তো আরেক দল এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। এমনকি এই দুই নেতাও বাইরে এসে এখন দল ও কর্মীদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, বিরোধিতা করতে গিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন।

রাজনীতি থেকে সহজ সৌজন্য ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে বলেই হয়তো এই দুটি নিতান্ত স্বাভাবিক সৌজন্য দৃষ্টান্ত এমন ব্যতিক্রমী ঠেকছে। ব্যতিক্রম হতে শিক্ষা নেওয়া যদি বিচক্ষণের কাজ হয়, তবে আওয়ামী লীগের এই ঘটনা থেকে শেখার নিশ্চয়ই আছে। কারণ, রাজনৈতিক সৌজন্য এ বাংলাদেশে একসময় ছিল। এখন আমাদের রাজনীতি অবশ্য অসৌজন্যকে একটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। বক্তৃতাতে নেতানেত্রীরা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে যেসব বাক্যবাণ ব্যবহার করেন, তা সভ্যতার পরিচায়ক নয়।

অনেকে বলছেন এটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাল। সেটা হলেই বা সমস্যা কোথায়? লোক দেখানো হলেও তো শিষ্টাচার প্রদর্শন নাগরিক ভদ্রতা। দাবা খেলায় অনেক চাল থাকে। মানতেই হবে, রাজনীতিটাও বিষম দাবার চাল।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ