X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে আইনের প্যাঁচ!

প্রভাষ আমিন
০৬ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৩৭আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৩৭

বিএনপির সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের মধ্যেই একটি মামলার রায় রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য দণ্ডিত হওয়া নতুন কিছু নয়। এর আগেও তিনি আরও চারটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। কিন্তু এবারের রায়টি আলোচনায় নতুন মাত্রা এনেছে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমানও দণ্ডিত হওয়ায়। এই রায়ের ফলে জুবাইদাও আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সংবিধানের ৬৬(ঘ) অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনও ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’। এর আগে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল জুবাইদা রহমান হয়তো দলের হাল ধরবেন।

পর্দার অন্তরালে থাকা ক্লিন ইমেজের জুবাইদা রহমান বিএনপির রাজনীতিতে আসছেন, এমন আলোচনা ছিল সরকারি মহলেও। কিন্তু গত বুধবারের এই রায়ের ফলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তাতে জিয়া পরিবারে কারও থাকার সম্ভাবনা কমে আসছে। এ কারণেই সর্বশেষ এ রায়টি নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা।

বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে ছোট করে মামলার বিষয়টি একটু জেনে আসি। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছর কারাদণ্ড আর এই ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করার দায়ে তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারেকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ২ কোটি ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭ টাকার সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন। এ ছাড়া তারেককে ৩ কোটি টাকা ও জুবাইদাকে ৩৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ওই মামলা করেছিল। ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় দায়ের করা মামলায় তারেক রহমানের শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুও আসামি ছিলেন। তবে মৃত্যুবরণ করায় তাকে এ মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে মামলা দায়েরের ১৬ বছর পর রায় হলো। মূলত হাইকোর্টে রিটের কারণে মামলাটির বিচার কাজ থেমে ছিল। রিট খারিজ হয়ে গেলে গত ১৩ এপ্রিল তারেক ও জুবাইদার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর সাড়ে তিন মাসে মাত্র ১৬ কার্যদিবসে ৪২ সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে রায় আসে।

রায় দিয়েছেন আদালত এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই। মামলার বিরুদ্ধে যেমন রিট করার সুযোগ ছিল, রায়ের বিরুদ্ধেও আপিল করার সুযোগ আছে। কিন্তু তারপরও এই আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে রাজনীতির মাঠেও। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, এটি ১/১১ সরকারের আমলে দায়ের করা মামলা। তাই এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। আর আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলেছে। এখানে সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ ছিল না। ১৬ বছর পর রায়কে কোনোভাবেই তাড়াহুড়ো বলা যাবে না। আর বিএনপি বলছে, এটার ফরমায়েশি রায়। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতেই এই সময়ে এই রায় দেওয়া হয়েছে।

সবসময় আইনের নিজস্ব গতির কথা বলা হলেও বাংলাদেশে আসলে আইনের নিজস্ব কোনও গতি নেই। সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা আইনের গতিকে প্রভাবিত করে। মামলা দায়েরের ১৬ বছর পর রায় হলেও এই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে আসলে মাত্র ১৬ কার্যদিবসে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় এটি আসলে সুপারসনিক গতি। ১/১১ সরকারের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে অনেক আগেই। এমনকি ২০১৪-১৫ সালের সহিংস আন্দোলন বা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অনেক মামলাও এখন ডিপফ্রিজে। এমন আরও হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে। তাই হুট করে তারেক-জুবাইদার মামলার রায় নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।  

তারেক-জুবাইদার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার মেরিট বা রায় নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হলো দণ্ডিত দুজনই পলাতক। আপিল করতে হলে তাদের ফিরে আসতে হবে। মামলার মেরিট বা রায় নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও রায়ের টাইমিং নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। বিএনপি যখন এক দফা আন্দোলন নিয়ে মাঠে নেমেছে, তখন এমন একটি রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলাই যায়। সরকারের উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে সফল। বিএনপি এখন এক দফা ছেড়ে তারেক-জুবাইদার মামলার রায়ের প্রতিবাদে কর্মসূচি দিচ্ছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে চাইবে। বিএনপি রাজপথে চাপ বাড়াতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে বিএনপি দেশে-বিদেশে সবার কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের চেষ্টা করছে। আগে হলে হয়তো সরকার মামলা-হামলায় বিএনপির আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করতো। কিন্তু মার্কিন ভিসানীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সতর্ক নজরদারির কারণে এখন আর আগের স্টাইলে বিরোধী দলকে দমন করা যাবে না। তাই সরকারি দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। ১/১১ সরকারের সময়ে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে বিদেশিদেরও কিছু বলার সুযোগ থাকবে না। বিদেশিরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে নজরদারি করছে। আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সামান্যই। এই সুযোগটাই নিয়েছে সরকার। এ কারণেই নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনের মধ্যেই দ্রুতগতিতে এ মামলার রায় হয়েছে বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

সরকারি দলের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে একটা অভিযোগ করা হয়। কার নেতৃত্বে তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন, বিএনপি নির্বাচনে জিতলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী, এই প্রশ্নে কাবু করার চেষ্টা করা হয় তাদের। প্রশ্নটা অযৌক্তিকও নয়। দণ্ডিত হওয়ায় বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগেই নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে আছেন। সর্বশেষ রায়ের পর জুবাইদা রহমানও ছিটকে গেলেন নির্বাচনি দৌড় থেকে। এই রায়ে বিএনপির এক দফার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা যাবে, নেতাকর্মীদের মনোবলে আঘাত করা যাবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপির মাথায় একটা নতুন চাপ দেওয়া যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে এবং আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড়। কিন্তু দেশি-বিদেশি মধ্যস্থতায় যদি দুই দলই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দিয়ে নির্বাচনের ব্যাপারে সম্মত হয়, তখন এই আপাত নিরীহ ও বিচারিক রায় রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অন্য সব শর্ত পূরণ হলেও খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং জুবাইদা রহমানকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যেতে রাজি হবে কিনা; তা নিয়ে সংশয় রয়েছ। তখন হয়তো আলোচনার টেবিলে এই রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সুবিধা পাবে সরকারি দল। আইনি ছাড় দিলে, অন্যদিকে কম ছাড়া দিলেও চলবে। আদালতের ওপর কোনও ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিন্তু দুই দলের সমঝোতা হলে নিশ্চয়ই এই রায়ের ব্যাপারেও নতুন কোনও কৌশল আসবে। আপিল করলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হয়তো দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। চাইলে সরকার নির্বাহী আদেশে রায় স্থগিতও রাখতে পারে।

সরকারি দলের নেতারা যাই বলুন, এই রায় নিছকই রাজনৈতিক হাতিয়ার। সমঝোতা না হলে এটা নিয়ে অনেক বক্তৃতা দেওয়া যাবে। আর সমঝোতা হলে এক লহমায় নতুন কৌশল বের হবে। আমরা চাই আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হোক।

২০১৪-২০১৮এর স্মৃতি ভুলে দেশ এগিয়ে যাক একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকৃত দোষীদের কেউ যে রেহাই না পায়। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় নিরীহ কেউ যেন সাজা না পায়। আইনি প্রক্রিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হোক। আইন চলুক সত্যিকার অর্থেই নিজস্ব গতিতে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খুলনায় আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা
খুলনায় আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা
রৌমারীতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ওপর প্রতিপক্ষের হামলা
রৌমারীতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ওপর প্রতিপক্ষের হামলা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ