X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তবে কি সাগর-রুনিকে কেউ খুন করেনি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৭আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৫৬

যা ভাবা হয়েছিল সেটাই হয়েছে। আবারও পিছিয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ। এবার নতুন তারিখ ঠিক হয়েছে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। গত সোমবার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তদন্ত সংস্থা র‍্যাব প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রাশিদুল আলম প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন দিন ঠিক করেন। এ নিয়ে ১০০ বার সময় পেছালো।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। দুজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এর পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি শেরেবাংলা নগর থানার মাধ্যমে তদন্ত শুরু হয়। এরপর চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা হিসেবে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশকে এটির তদন্তভার দেওয়া হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়।

এরপর ২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের নির্দেশে আলোচিত এই হত্যা মামলার তদন্তভার র‍্যাবের ওপর ন্যস্ত করা হয়। মামলায় রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি ৮ জন।

সংক্ষেপে এই হলো মামলার ফিরিস্তি। পৃথিবীর বহু খুন ক্লুলেস হয়, অর্থাৎ কোনও প্রমাণ থাকে না। এই সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ড কি সেরকম কিছু? কিন্তু র‍্যাবের কথায় তো সে রকম মনে হচ্ছে না। র‍্যাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিএনএ টেস্টের যে প্রতিবেদন এসেছে, সেখানে দুজন অপরাধীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের শনাক্তে কাজ চলছে। তাদের শনাক্ত করতে না পারায় এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে দেরি হচ্ছে। এর অর্থ হলো প্রমাণ আছে, কিন্তু আসামি ধরা যাচ্ছে না।

মামলাটি ঘিরে দেশজুড়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরপর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরা হবে। এই এক যুগে কত ৪৮ ঘণ্টা যে চলে গেলো!

পুরো ঘটনার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িয়ে গেছে। একদিকে হলো আমাদের এলিট বাহিনী হিসেবে পরিচিত র‍্যাবের সক্ষমতার প্রশ্ন, অন্যদিকে সরকারের সদিচ্ছা। অনেকে ভেবে বসে আছেন, এই সাংবাদিক দম্পতির কাছে এমন কোনও তথ্য ছিল, যে কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে না। বিষয়টি তাই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার জায়গায় স্পর্শ করে চলেছে।

এই মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না, বিচার তো দূরের কথা। এই হত্যাকাণ্ডের পর সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ হয়েছে। একপর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সাংবাদিক ইউনিয়ন একত্রিত হয়ে আন্দোলনও করে। কিন্তু আন্দোলন সফল হয়নি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ এই আন্দোলনের সাফল্য ঘরে তুলেছেন বলে জনশ্রুতি আছে এবং তারা পরবর্তীতে পদ-পদবি পেয়েছেন।  

ভয়ংকর হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের ১২ বছর হয়ে গেলো। এরমধ্যে নতুন সরকার এসেছে দুই দুইবার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হাতবদল হয়েছে বহুবার। দেশকে আলোড়িত করেছে যে হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক সমাজসহ সব পরিবারকে যে ঘটনা আতঙ্কিত করেছে, সাংবাদিক দম্পতির শিশুসন্তানের করুণ কষ্টে যেখানে সবাই মর্মাহত, সেখানে বারবার এর তদন্ত প্রতিবেদন পিছিয়ে যাওয়া কেবল বেদনার নয়, মনে হয় যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিহাস করছে। এসবে না আছে যুক্তি, না আছে সান্ত্বনা।

এই যে র‍্যাব একটি এরকম চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পারছে না, সেটা কি লজ্জার নয়? নিষ্ঠা ও সৎ সাহসের অভাব নয়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই দায়সারা গোছের তদন্ত এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে জনমনে ক্ষমতাসীন সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আদালতে তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলো।

প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ব্যর্থতার জন্য তাদের কি কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে? মামলাটি পরে র‌্যাবের দায়িত্বে দেওয়া হলো সেই সময়েই এবং এই বিশেষ বাহিনীও হত্যার রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ হয়ে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। বাস্তবতা হলো, এসব ব্যর্থতার দায়ভার কোনও না কোনোভাবে সরকারের ওপরই বর্তায়।

ফৌজদারি মামলার বিচার যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য স্পষ্ট বিধান আছে। এমন একটি ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব এখন র‍্যাবের হাতে, যেটি কিনা পুলিশেরই একটি বাহিনী। তো, এই বাহিনী কি ব্যর্থ হতে পারে? যে পুলিশ বা র‍্যাব চাইলেই যে কারও বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করতে পারে, কেবল সন্দেহের বশে যে কাউকে বন্দি করতে পারে, স্বীকারোক্তি আদায় করতে মৃত্যুর ভয় দেখাতে পারে, এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে বিচারও করতে পারে, তারা কেন একটা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারে না? প্রশ্ন আরও আছে– যে বাহিনী মানবাধিকার কিংবা আইনকে পদপিষ্ট করতে দ্বিধা করে না, তারা যদি ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে দায় আসলে কার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের?

একটা গভীর মনোবেদনা থেকে বলতে হচ্ছে, তদন্ত প্রতিবেদন এমনভাবে পিছিয়ে যেতে যেতে একদিন আর মনেই পড়বে না সাগর-রুনি বলে আমাদের জীবনে কেউ ছিল। সেটাই হয়তো ভালো, কারণ তখন আমাদের আর এটা ভেবে কষ্ট পেতে হবে না যে এই নামে কেউ ছিল আমাদের মাঝে। যারা ছিলই না তারা কি খুন হয়েছিল? অথবা বলবো, কেউ খুন করেনি সাগর-রুনিকে?

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ