X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন সাইবার আইন: ইতিবাচক অনেক কিছু, অপপ্রয়োগ যেন না হয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩০ আগস্ট ২০২৩, ২১:৪৭আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ২২:০১

ভয়াল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা যখন তার জেল জীবনের এক বছর পূর্ণ করলেন, তখন সরকার সেই আইন বাতিল করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন মন্ত্রিসভায় পাস করলো। এখন সংসদে গিয়ে এটি আইনে পরিণত হবে।

২০২২ সালের ২৭ আগস্ট তিনি গ্রেফতার হন। এরমধ্যেই জীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেছে তার। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী খাদিজা পড়াশোনার পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। তার একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বিদেশে বসে সরকারবিরোধী কথা বলা ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেন। সেটাই খাদিজার জন্য কাল হলো। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর কলাবাগান ও নিউ মার্কেট থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ।

যিনি বিদেশে বসে কথাগুলো বলছেন সেই মেজর দেলোয়ার নিজেও ইউটিউব চলান। অন্যদের আলোচনায়ও যান। এরকম আরও অসংখ্য আছে। এরকম প্রবাসীদের কিছুই করতে পারছে না সরকার। ভুগতে হচ্ছে খাদিজাদের মতো মানুষদের, কারণ তাকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে।  

একটি রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন করা হয় মানুষের জন্য। কিন্তু সেই আইন যদি মানুষকে ভীত করে তোলে, যদি দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে, তবে প্রশ্ন উঠবেই যে সে আইন কীসের আইন? কার জন্য আইন? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এমন একটি আইন, যার নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্কবোধ করে।

শিক্ষার্থী, মানবাধিকার ও সংস্কৃতি কর্মী, সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্ট, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ– অতি অল্প সময়ে এই আইনে নিপীড়িত হওয়ার তালিকাটা অনেক দীর্ঘ।

দেশে-বিদেশে তুমুল সমালোচনা, ব্যাপক হারে আইনের অপপ্রয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় এসে সরকার বহু বিতর্কিত নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ আনলো। নতুন আইনে জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি, বর্তমান আইনে তা কমে হয়েছে ৪টি। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে সাজার পরিমাণও অনেক ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। এগুলো অবশ্যই স্বস্তিদায়ক।

২০১৮ সালে এই আইনটি পাসের আগে এবং পরে দেশের সাংবাদিক সমাজ, নাগরিক সমাজ, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মীরা শত আর্জি জানিয়েও সরকারকে নড়াতে পারেনি। অবশেষে এ বছর এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন অফিস ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানায়। এরপরই পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়।

২০১৮ সালে এই আইন সংসদে উত্থাপন করে মাত্র কয়েক মিনিটেই পাস করিয়ে নেয় সরকার। এই আইন পাস করে, প্রয়োগ করে এবং হাজারো সমালোচনার পরও বজায় রেখে সরকার বা দেশের কী লাভ হয়েছে সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে কখনও জানাতে পারেনি। তবে এই আইন যে দেশে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এতে সন্দেহ নেই। আইন চালু হওয়ার পরে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা, সাংবাদিকরা এবং অবশ্যই বিভিন্ন মতের রাজনীতিকরা। একটা পর্যায়ে দেখা গেছে প্রয়োগটাই অপপ্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সমাজবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ, সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে নিপীড়নের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলে এই আইনের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এবং মূলত এই আইন যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণে মত প্রকাশের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানীতে এসে ঠেকেছে। প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের করা বার্ষিক সূচকে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অবনতির দিকে ধাবমান।

সাইবার নিরাপত্তার জন্য যেসব ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেই ধারাগুলো প্রস্তাবিত আইনে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব বিষয়কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো, প্রস্তাবিত আইনেও সেগুলো অপরাধ। জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর ২১ ও ২৮ ধারা সম্পূর্ণ বিলোপের আহ্বান রেখেছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। বর্তমান আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে ২১ ধারাকে। এতে সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা আগের মতোই রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

তবে অনেক ইতিবাচক দিক আছে, যেমন- মানহানির ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। প্রস্তাবিত আইনে সেটি পরিবর্তন করে করা হয়েছে জরিমানা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতো। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ড, অনধিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। জরিমানা না দিলে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। মামলা করে সাথে সাথে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর প্রক্রিয়াটা বন্ধ হবে বলেই মনে হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এটি কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। সাত বছরও অতিরিক্ত এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য প্রতিবন্ধক।

একটা সমালোচনা হচ্ছে যে প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে কেবল ১৪ দিন সময় দিয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে। সংসদেও বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে মনে হয় না। এখন সংসদে পাস করার আগে নতুন আইন নিয়ে অংশীজনদের সাথেও কতটা আলোচনা হয় সেটা দেখার বিষয়। উদ্বেগের বিষয় এই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হলেও এই আইনে করা মামলাগুলোর বিচার নতুন আইনে হবে না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই হবে। সরকার জগন্নাথের খাদিজার ব্যাপারে নমনীয় হোক এই এক বছরের মাথায় এসে, সেটা নাগরিক প্রত্যাশা।

প্রস্তাবিত আইনের ৪২ ধারায় পুলিশের একজন কর্মকর্তার হাতে বিচারিক ক্ষমতা রেখে দেওয়া হয়েছে, যা আগের আইনের ৪৩ ধারায় ছিল। তার ক্ষমতা আছে যখন তখন যেকোনও ব্যক্তির মোবাইল বা অন্য ডিভাইস চেক করার বা বাজেয়াপ্ত করার। নতুন আইনে এই ক্ষমতা রেখে দেওয়ায় ভয় দূর হলো না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও এর বিধির ন্যায্যতা-অন্যায্যতা নিয়ে যে ঘোর বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার পরিবর্তনই আশা করছে সবাই। ডিজিটাল স্পেসে বিদ্বেষ, হিংসা ছড়ানোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু কোনটা সত্যিকারের বিদ্বেষ ছড়ানো আর কোনটা রাজনৈতিক মতামত সেটি বুঝতে পারতে হবে, সেই সহনশীলতা থাকতে হবে। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনের অভিজ্ঞতা যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো না হয়। সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকবান্ধব ও মত প্রকাশবান্ধব হোক।

লেখক: সাংবাদিক

  

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ