X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগকারী না পাচারকারী?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৫৯আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৫৯

সম্প্রতি ছোট এক সফরে দুবাই যাওয়া হয়েছিল। যেসব দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের ঘনত্ব বেশি তার মধ্যে অন্যতম সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। খবর পেলে অনেকে দেখা করতেও আসেন। এসব কথার বেশিরভাগজুড়ে থাকে তাদের কষ্টের কথা, তাদের প্রতি সেখানকার দূতাবাস এবং বাংলাদেশে এলে বিমানবন্দরে দুর্ব্যবহারের কথা। আর থাকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নানা আলাপ।

তবে এবার সব ছাপিয়ে উঠে আসে বিনিয়োগ প্রসঙ্গ। তারা জানায়, হঠাৎ করে গত কয়েক বছর ধরে দুবাইসহ আরব আমিরাতের বিভিন্ন প্রদেশে বাংলাদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। তারা জানান, এখন দ্রুতগতিতে বাড়ছে বাংলাদেশিদের নিবন্ধিত কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।

পত্রিকার খবরেও জানা গেলো যে চলতি বছরের কেবল প্রথমার্ধেই (জানুয়ারি থেকে জুন) দুবাই চেম্বার অব কমার্সে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সদস্যপদ নেওয়ার হার প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ছয় মাসে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন ১ হাজার ৪৪টি কোম্পানি দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ নিয়েছে। তাতে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানির মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৫টি।

গোল্ড সোক বলে পরিচিত দুবাই সোনার বাজারে বাংলাদেশি দোকানের দেখাও মিললো। প্রশ্ন জেগেছে, এরা কি বিনিয়োগকারী, না অর্থপাচারকারী? প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, দেশ থেকে টাকা পাচার করে এনে এখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। পাচার করে আনার সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই, তবে সব প্রবাসীর কাছে এটাই সাধারণ ধারণা। এবং এ কথার যে সত্যতা আছে সেটা আন্দাজ করা যায়। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ব্যবসা করতে গেলে অনুমতি নিতে হয়। আরব আমিরাতে এ ধরনের অনুমোদনের তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিদেশে অফিস কিংবা ছোট আকারের কারখানা গড়ে তুলছে, যেগুলোর কোনোটিই আরব আমিরাতে নয়।

তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে এত বাংলাদেশি বিনিয়োগ কী করে গেলো? সেখানকার মানুষজন নাম ধরে ধরে বলছে, অমুকে এত মিলিয়ন/বিলিয়ন এনেছে। বিনিয়োগের খাতগুলো হচ্ছে, আবাসন, বুটিক, হোটেল ও তারকা হোটেল। বেশি বিনিয়োগ হয়েছে দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি ও আজমানে। শ্রম দিতে গিয়ে বিনিয়োগকারী হয়েছেন সে রকম সংখ্যা খুব বেশি নেই, তবে আছে। সেরকম দুই একজন বলছেন এরা (হঠাৎ বিনিয়োগকারীরা) এত টাকা কোথায় পেলো?

ব্যাংক ঋণের টাকা, প্রকল্পের টাকা, ঘুষ আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা, কমিশনের টাকা, যোগসাজশের মাধ্যমে আয় করা টাকাই এগুলো। আমদানি-রফতানির আড়ালেও পাচার হয় টাকা। ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা লোকজন অথবা এদের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ নির্গমনের পথ চওড়া হয়েছে বাংলাদেশে।

হঠাৎ করে আমিরাত কেন গন্তব্য? এমন প্রশ্নের জবাবও দিলেন প্রবাসীরা। তারা মনে করেন, আমেরিকা বড় দুর্নীতিবাজদের স্যাংশন বা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এমন ভয়ে এখানে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছেন অনেকে। আগে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ গেছে মূলত আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপেই। এখন গন্তব্য বদলাচ্ছে। টাকা পাচারের র‍্যাকেট অনেক বড় এবং বছরের পর বছর ধরে গজিয়েছে। নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ধীরে ধীরে ডানা ছড়িয়েছে।

অর্থপাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সব দেশ থেকেই টুকটাক হয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার মাত্রাছাড়াভাবে হচ্ছে বলেই রিপোর্ট হচ্ছে অনেক বছর ধরে। ২০১৬ সালের এক খবরে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা এবারের জাতীয় বাজেটের চেয়েও এক লাখ কোটি টাকা বেশি। বলা হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অর্থপাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে, আর অর্থপাচারের দিক থেকে শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে নাম আছে বাংলাদেশের। নির্বাচনের আগে টাকা পাচার বাড়ে, কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা টাকা পাচার উৎসাহিত করে। তবে যথাযথ বিনিয়োগের পরিস্থিতি না থাকলেও টাকা বাইরে চলে যায়।

আমাদের মনে থাকবার কথা, মানি লন্ডারিং আইনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দুদকের হাতে থাকাকালীন ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনায় দুদকের সাফল্য থাকলেও পরে এ বিষয়ে সাফল্যের আর কোনও নজির সৃষ্টি হয়নি। কোনোভাবেই অর্থপাচার রোধ করা যাচ্ছে না বা কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কোনও প্রচেষ্টাও নেই এখন সেভাবে।

অনেকেই বলছেন অর্থপাচারকারীদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু শুধু তালিকা প্রকাশ করে কোনোই সুফল মিলবে না, যদি আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা না যায়। আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, কিন্তু দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অথচ তা রোধ করা যাচ্ছে না, এটা কোনোভাবেই একটি উন্নয়ন প্রত্যাশী শাসন ব্যবস্থার চিত্র হতে পারে না। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের ঊর্ধ্বমুখী অর্থনীতিকে টান মেরে নিচে নামানোর কাজটাই করছে এই পাচারকারীরা।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবে হামাস, আশা যুক্তরাষ্ট্রের
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
সিগারেট বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
সিগারেট বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ