X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিস্তিনি নিধনে ইসরায়েলের বর্বর অভিযান ও দুর্বল ইমানের মুসলমান

মো. জাকির হোসেন
২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:২১আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:৩৯

ফিলিস্তিনের প্রয়াত কবি মাহমুদ দারবিশ ‘দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস’ কবিতায় লিখেছেন–

‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে,
ধরিত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়,

...

শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবোটা কোথায়?
শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?
হয়ার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই?’

খোলা আকাশের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার গাজায় যে বিপর্যয় ঘটছে তা মাহমুদ দারবিশের বর্ণনার চেয়েও ভয়ংকর। কেবল একতরফা যুদ্ধ, আক্রমণ বা গাজা দখল নয়; পুরোদস্তুর গণহত্যা চলছে গাজায়। অবিরাম বোমাবর্ষণে নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে আবাসিক ভবন, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জা, হাসপাতালসহ নানা অবকাঠামো। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর নির্দেশে ফিলিস্তিনিরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলে দলে ছুটছে, তখন বিমান থেকে তাদের ওপর বোমা ফেলা হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরে, মসজিদে ও হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা ফেলে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করছে, সেখানে হামাসের সামরিক আস্তানা রয়েছে।

একটি হাসপাতালে টার্গেট করে বোমা ফেলে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হাসপাতালে বোমাবর্ষণের পর প্রথমে ইসরায়েল বলেছে হাসপাতালে হামাসের যোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন বলেই সেখানে হামলা করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক কোনও সংবাদমাধ্যম প্রচার করেনি। ইসরায়েল পরে তার ভাষ্য পরিবর্তন করে ইসলামি জিহাদের রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কথা বলছে, যা সর্বৈব মিথ্যা। নির্বিচার বিমান হামলায় গাজার বিধ্বস্ত ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু চাপা পড়ে আছে বলে জানিয়েছে শহরটির কর্তৃপক্ষ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ ও শরীরের খণ্ডিত অংশে পচন ধরেছে। বাতাসবাহিত রোগ ও কলেরা ছড়িয়ে গেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় তারা গাজার ৪০০ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এতে নিহত হয়েছে ৭৪০ জন।

হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে আহত, চিরতরে পঙ্গু হওয়া মানুষের ভিড়। চিকিৎসকেরা বলছেন, বোমায় আহত ব্যক্তিদের ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে যেন তাদের ত্বক গলে যাচ্ছে। এই ক্ষত চিকিৎসায় কোনও ওষুধ হাসপাতালে নেই। ইসরায়েল কী ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে, তা খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

অভিযানের নিষ্ঠুরতা ও ব্যাপকতাকে জাতিসংঘ মহাসচিব ‘নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়’ বলেছেন। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা যতটুকু নৃশংস হতে পারে, গাজায় তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটছে। নির্বিচারে অসহায়, বিপর্যস্ত শিশু, নারী ও পুরুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে নেতানিয়াহু ও বাইডেনের যৌথ অভিযান। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় নিহতদের একটি বড় অংশই শিশু। ফিলিস্তিনি বাবারা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বোমার আঘাতে মৃত সন্তানের শরীরের কোনও একটা অংশ বুকে চেপে কাঁদছেন। হাসপাতালগুলোর মর্গে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুদের শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন ফিলিস্তিনের অসংখ্য মা-বাবা।

এ অবস্থায় গাজা উপত্যকায় নতুন এক প্রবণতা দেখা গেছে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে। সন্তানদের শরীরের বিভিন্ন অংশে তাঁরা নাম লিখে রাখছেন—যেন এই নাম দেখে তাদের মরদেহ শনাক্ত করা যায় সহজেই। আল-আকসা মার্টিয়ারস হাসপাতালের প্রধান আব্দুল রহমান আল-মাসরি সিএনএনকে জানান, তারা বেশ কিছু শিশুর মরদেহ পেয়েছেন, যাদের পা, পেট কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশে মা-বাবারা নাম লিখে রেখেছিলেন। মাসরির মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তানের ক্ষেত্রে যেকোনও কিছুই ঘটে যেতে পারে। বোমার আঘাতে মারা গেলে শিশুদের মরদেহ দেখে অনেক সময় চেনার উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে কালো কালি দিয়ে শরীরে লিখে রাখা নাম চেনার উপায় হতে পারে।

হাসপাতালে আনা অনেক শিশুর শরীরে এভাবেই লেখা রয়েছে তাদের নাম। বিষয়টিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি নতুন প্রবণতা হিসেবেও উল্লেখ করেন মাসরি। তিনি জানান, অতীতে এই বিষয়টি কখনোই দেখা যায়নি। চলমান সংঘাতের মধ্যে গাজায় প্রতি ৫ মিনিটে একজন করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।

চিকিৎসকদের তথ্যমতে, গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা আহতদের ৪০ শতাংশই শিশু। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করে মূলত একটি প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছে হাজার হাজার শিশু। জাতিসংঘ জানিয়েছে, হাসপাতালেও বোমাবর্ষণের ফলে উত্তর গাজায় বিধ্বস্ত চারটি হাসপাতাল আর চিকিৎসা দেওয়ার অবস্থায় নেই। অপর দিকে গাজার ২১টি হাসপাতাল ইসরায়েল বাহিনী খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

সংস্থাটি বলছে, গত ১০ দিনে গাজার ১১০টির বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। বিদ্যুৎবিহীন হাসপাতালে মোবাইল ফোনের আলোয় চিকিৎসা চলছে। চেতনানাশক ছাড়াই সার্জারি করা হচ্ছে। হাসপাতাল মর্গে লাশ রাখার জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে আইসক্রিমের ফ্রিজারেও লাশ রাখতে হচ্ছে।

একটি সশস্ত্র যোদ্ধা গোষ্ঠীকে নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে গাজার পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে খাদ্য,  পানীয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা এবং নির্বিচারে বোমা ফেলে শায়েস্তা করার নীতি যুদ্ধাপরাধ ছাড়া কিছু নয়। গাজায় পানি ফুরিয়ে এসেছে, মাথাপিছু প্রাপ্তি তিন লিটারে নেমেছে, লাশ গোসল করানোর পানি নেই। অবরুদ্ধ গাজার খান ইউনিসের বাসিন্দা ইমাদ আবুয়াসি বলেছেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে এক টুকরা খাবারের জন্য মানুষ খুনোখুনি শুরু করবে। আপনি একটু রুটি কিনতে যান, দেখতে পাবেন মানুষ কীভাবে ধাক্কাধাক্কি করছে।’

খাবারের অভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন উপত্যকাটির ২৩ লাখ বাসিন্দা। ফিলিস্তিনিদের গাজা ত্যাগে বাধ্য করতে খাদ্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এক ভয়ংকর নারকীয় অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে গাজায়। কোথাও কোনও নিরাপদ জায়গা নেই। পালিয়ে যাওয়ারও কোনও জায়গা নেই। ইসরায়েলের পথে পথে বহু ইহুদিকে অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের বেছে বেছে হত্যা করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাধারণ ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে উসকে দিতে বর্ণবিদ্বেষী প্রচারণাও শুরু হয়েছে।

ইসরায়েলের সাবেক জেনারেল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দাইয়ান একবার বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলকে পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করতে হবে, খেপালেই বিপদ, এমন একটা ধারণা যেন সবার মনে গেঁথে যায়।’

তারই পথ অনুসরণ করে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ফিলিস্তিনিদের ‘নরপশু’বলে উল্লেখ করেছেন। ইসরায়েলের লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচ সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের রাফা সীমান্ত দিয়ে মিসরে পালিয়ে যাওয়া উচিত। অন্যদিকে, ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সদস্য রেভিতাল গোতলিভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, এখনই গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা দরকার। জিওরা ইলান্দ নামের একজন ইসরায়েলি সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, গাজায় আরেকটি নাকবা ঘটাতে হবে। সেখানে ‘নজিরবিহীন বিপর্যয় ঘটাতে হবে’।

১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের দেশত্যাগের এই ঘটনা নাকবা বা মহাবিপর্যয় নামে পরিচিত। ৭৫ বছর পর দ্বিতীয় নাকবা শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা পুরো গাজা শহর থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলছেন। এর আগে নাকবার সময় গাজার ফিলিস্তিনিরা সাগরের কাছাকাছি রিমাল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এবার তাও সম্ভব নয়। এবার সেখানেও তীব্রভাবে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। বোমাবর্ষণের পাশাপাশি অবরুদ্ধ গাজাবাসীকে অভুক্ত রাখা হচ্ছে, তাদের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

গাজা নামের এক টুকরো জমির দখল নিতেই এই দানবীয় পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর। কর্তৃত্ববাদের ডিএনএ যার শরীরে তার মতো ঘৃণিত মানুষই পারেন পৃথিবীর বুক থেকে গাজাকে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে। ক্ষতি, বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান ও জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রের প্রাণঘাতী হামলা সহ্য করে যে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম গাজা নামক কারাগারে কোনোরকমে বেঁচে আছেন, নেতানিয়াহু এবার তাদের সম্পূর্ণরূপে নিধন করতে চান।

ইসরায়েলের এই ফিলিস্তিনি জাতি নিধনের প্রধান সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে যেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে। সঙ্গে দিয়েছে কূটনৈতিক সমর্থন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজে ইসরায়েলে উড়ে গেছেন। গিয়ে বলেছেন, আপনারা একা নন। সেই সাথে সগর্বে ঘোষণা দিয়েছেন, আমি ইহুদি নই, জায়নবাদী। গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে একাধিকবার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের সদস্যদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যে এই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বারাক ওবামা ও তার পূর্বসূরিদের মতোই সবুজ সংকেত দিয়ে ইসরায়েলের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে।

ইসরায়েলকে গণহত্যার সহযোগিতার পাশাপাশি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে সতর্ক করেছে যেন তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রকে কেউ আঘাত করতে না পারে। ইসরায়েলকে রক্ষায় দুটি রণতরিও মোতায়েন করেছেন বাইডেন। এটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি বাইডেন প্রশাসন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এই বার্তা মধ্যপ্রাচ্যের সব অংশীজনকে জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, এই হামলার কোনও কূটনৈতিক সমাধান নেই; একমাত্র বিকল্প সামরিক অভিযান।

একতরফা সামরিক অভিযানে নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। পঞ্চাশটি পরিবারের সবাই নিহত হয়েছেন। মৃতদের প্রতি শোক জানানোর জন্য কোনও স্বজন বেঁচে নেই। বিধ্বস্ত  উপত্যকায় অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে গত ২১ অক্টোবর প্রথম দফায় ২০ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী গাজাতে পৌঁছেছে।

বিবিসি সংবাদদাতা রুশদি আবু আলুফ শনাক্ত করেছেন, একটি ট্রাক কেবল কফিনে বোঝাই। ত্রাণ হিসেবে কফিন প্রাপ্তি অভূতপূর্ব ও নির্মম মনে হলেও অজস্র নিরপরাধ মানুষের লাশ কফিনকেই স্বাগত জানিয়েছে। মৃত মানুষের আহারের কী দরকার?

বর্ণবাদী, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে ক্ষমতাধর সব রাষ্ট্র রয়েছে। অস্ত্র, অর্থ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনীতির মাধ্যমে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নিধনকে সহযোগিতা করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ফিলিস্তিনের পাশে কার্যত কেউ নেই। না পশ্চিমা সরকারগুলো, না আরব দেশগুলো। না মূলধারার মিডিয়া, না সোশ্যাল মিডিয়া। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা কোণঠাসা হতে হতে একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে।

আরব লিগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কায়রোতে একটি জরুরি বৈঠক শেষে মৃদু ভাষায় দুই পক্ষের বেসামরিক জনগণকে নিশানা করে হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন, নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন আরব দেশগুলোর একটিও ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা বা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া বাতিল করা বা দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি।

মিসরের উদ্যোগে লোক দেখানো একটি শান্তি আলোচনার আয়োজন করা হলেও অংশ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। তাই সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে আলোচনা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। কোনও মুসল্লিকে মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে শুধু ইহুদিরা প্রবেশ করছেন। সেখানে ইহুদিদের প্রার্থনা করার সুযোগ দিয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ। এরপরও ‘আকাশ থেকে আবাবিল পাখি নেমে আসার অপেক্ষায়’ নির্বিকার ও নির্লিপ্ত মুসলিম উম্মাহর নেতারা। অথচ পবিত্র কোরআনে মহান রব বলেন, “আর তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছো না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।” (সুরা নিসা: আয়াত ৭৫)।

ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, ‘A friend in need is a friend indeed.’ অর্থাৎ বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। ফিলিস্তিনিদের এই ভয়াবহ বিপদের দিনে ২৩টি আরব দেশ, ৫৭টি ইসলামিক রাষ্ট্র এবং ২০০ কোটি মুসলমান মিলে অবরুদ্ধ গাজায় মৃত্যুন্মুখ মুসলমানদের বাঁচাতে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময়ে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা দৃষ্টিগোচর হয়নি। কেবল বাংলাদেশ সরকার স্রোতের বিপরীতে নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে।

ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা ও স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফিলিস্তিনিদের যে জায়গাগুলো দখল হয়ে গেছে, সেগুলো তাদের ফেরত দেওয়ার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেছেন। ফিলিস্তিনি শহীদদের জন্য দেশের প্রতিটি মসজিদে এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দোয়া ও প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য ওষুধসহ শুকনো খাবার এবং শিশু ও নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যার অবস্থান বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ফিলিস্তিন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নীতিকেই অনুসরণ করছেন তিনি। ভান-ভণিতা না করে বঙ্গবন্ধুকন্যা মানবাধিকার, ন্যায্যতা, মানবিকতা ও ইসলামের পথকেই অনুসরণ করছেন।

নেতানিয়াহু-বাইডেনের যৌথ বর্বরতার প্রতিবাদ করছে ইহুদিরাও। জায়নবাদীদের তীব্র সমালোচনা ও অশালীন আক্রমণ তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারেনি, ইসরায়েল রাষ্ট্রের দমননীতি তাদের টলাতে পারেনি। বরং তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।

অথচ বাংলাদেশের কিছু মুসলমান প্রতিবাদ দূরে থাক, আমেরিকা যাতে অসন্তুষ্ট না হয় সেজন্য জবান সিলগালা করে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। বিএনপির এক নেতা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবতার, বাবা ও ‘ভগবান’ আখ্যা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই। আর বিএনপির আরেক মিত্র দলের নেতা মেন্দি সাফাদির শরণাপন্ন হয়েছেন রাজনৈতিক সহযোগিতার জন্য। ইসলাম ধর্ম জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে উত্তম আচরণ ও ভালো ব্যবহারে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রতি এ হুকুম সাব্যস্ত হবে না, যারা প্রকাশ্যে ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।

সুতরাং ইসলাম ও মুসলমানের সঙ্গে যারা শত্রুতা করে, শত্রুতায় সহযোগিতা করে, প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই বন্ধুত্ব করার হুকুম নেই। কোথাও অন্যায় হতে দেখলে তার প্রতিবাদ করা ইসলামে জরুরি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা অন্যায় কাজে বাধা দেয় না তাদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। এবং দুনিয়াতেও আল্লাহর আজাবের মুখোমুখি হবে তারা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ কোনও অন্যায় দেখলে সে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে, যদি সে তাতে সক্ষম না হয়, তবে সে যেন মুখে প্রতিবাদ করে; আর যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এটাই ইমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, এরপরে সরিষা পরিমাণ ইমানও বাকি নেই।’ (মুসলিম, ৪৯; আবু দাউদ, ১১৪০)।

নেতানিয়াহু-বাইডেনের যৌথ বর্বরতায় গাজায় যখন রক্তের প্লাবন বইছে, দুর্বল ইমানের মুসলমানরা তখন দুনিয়ার ক্ষমতা, ভোগ-বিলাস, লোভ আর লাভের হিসাবে মেলাতে ব্যস্ত। তারা হয়তো প্রত্যাশা করছে, গাজার নির্যাতন শিবিরে ফিলিস্তিনিরা ঠোঁট কামড়ে পড়ে থেকে সব নির্যাতন সহ্য করে যাক। একদিন আকাশ থেকে গায়েবি সাহায্য আসবে। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা অবশ্যই… অন্যায়কারী বা অত্যাচারীকে হাত ধরে বাধাদান করবে, তাকে সঠিক পথে ফিরে আসতে বাধ্য করবে…..। যদি তোমরা তা না কবো তাহলে আল্লাহ তোমাদের… অভিশপ্ত করবেন।’(মাজমাউজ জাওয়াদ ৭/২৬৯)।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ