X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের শাসনব্যবস্থা: এক অনালোচিত দিক

এম আর ইসলাম
২২ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:১২আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২৩

নির্বাচন নিয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। যেহেতু এই সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অবৈধ বা অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে, তাই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। ‘ভাসুরের নাম যেমন মুখে আনতে নেই’, ‌‌‌“তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নাম উচ্চারণ করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা খানিকটা সেরকম।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশ সংবিধানের সাথে কোথায় কোথায় সাংঘর্ষিক, সে বিষয়ে অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, আজকের এই লেখা মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য একটা দিক নিয়ে, যে বিষয়টা আমজনতাকে খানিকটা নস্টালজিক করে দিতে পারে। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ চারটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেখেছে। এর মধ্যে একটা (১৯৯১-এর) ছিল অনানুষ্ঠানিক, আর বাকি তিনটা  (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর) ছিল আনুষ্ঠানিক বা সাংবিধানিক। তবে ২০০৮ সালের পরে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে। কারণ, বড় দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে নিস্তার পায়নি, বা ছাড় পায়নি। নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা, অথবা সংবিধানের সাথে এই সরকার ব্যবস্থার কী সংশ্লিষ্টতা বা অসংশ্লিষ্টতা তা এই লেখার উপজীব্য নয়।

সাধারণ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কেমন বোধ করতো, অথবা সর্বোপরি শাসনব্যবস্থা তখন কেমন ছিল, তার কিছু স্মৃতিচারণের জন্য এই লেখার অবতারণা।  

প্রথমে আসা যাক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা। এই পর্যন্ত গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর বেশিরভাগ সদস্যই গ্রহণযোগ্য ছিলেন তাঁদের শিক্ষাগত, পেশাগত ও নীতিগত শুদ্ধাচারের জন্য। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তারা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। কোনও রাজনৈতিক সরকারই দুর্নীতি নির্মূল করতে আন্তরিক ছিল না। হয় তারা দুর্নীতি করতে সাহায্য করেছে, নয়তো নিজেরাই দুর্নীতিতে গা ভাসিয়েছে। এ দেশে সাধারণ মানুষের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনপ্রিয় হবার অন্যতম কারণ ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের শক্ত অবস্থান ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করার ক্ষেত্রে তারা তাদের পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের নজর কেড়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল।

অনেক দুর্নীতিবাজ টাকার বস্তা বাথরুমে ফেলে দিতো; ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত না রেখে তারা কোলবালিশের মধ্যে টাকা রেখেও পার পেতো না। দামি হামার গাড়ি ফেলে, মালিক পালিয়ে যেতো। রাস্তায় পড়ে থাকতো দামি আর বিলাসবহুল সব ব্যক্তিগত যানবাহন। কোটি টাকার ব্যাগ পড়ে থাকতো ডাস্টবিনের পাশে। এই মেলো ড্রামা সাধারণ মানুষেরা খুব উপভোগ করতো। কারণ, রাজনৈতিক সরকারগুলোর কাছ থেকে এমন আইনের শাসন দেখার সুযোগ তেমন একটা পাওয়া যায়নি। ওই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে, দুর্নীতিবাজ আমলা, কপট রাজনীতিক, মজুতদার ব্যবসায়ী সব থরে কম্পমান থাকতো। এমনটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে অনেকেই আবার দুর্নীতির সাথে জড়িয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর একটা দিক ছিল সড়ক পথে শৃঙ্খলা ফেরত আনা। এ দেশের সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়, তা বোঝা যায় সড়ক পথে তাদের যাতায়াতের সময়। ফিটনেসবিহীন বাস, বেপরোয়া গতি, লাইসেন্সবিহীন চালকদের দাপট, হেলমেটবিহীন বাইকার আর ভাঙাচোরা বাসের ড্রাইভারদের ইচ্ছাকৃত বাধানো জ্যামে সাধারণ যাত্রীদের জীবন ছিল যন্ত্রণাময়। এমন অব্যবস্থাপনা থেকে বের করে আনতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টারা। এখনও মনে আছে, মিরপুর টেকনিক্যালের মোড়ে লাঠি হাতে দাঁড়ানো থাকতো এক সেনাসদস্য, তাতেই বাস কল্যাণপুর থেকে সাভার পৌঁছাতো মাত্র ২০ মিনিটে। বাইকাররা মাথায় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি চাপিয়ে চলতো মামলা বা তাৎক্ষণিক শারীরিক শাস্তি পাবার ভয়ে। মাসিক মাসোহারার চুক্তিতে ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন বাস রাস্তায় নামার সাহস পেতো না। নাগরিক জীবনে কিছু অস্বস্তি থাকলেও, মানুষ এমন শৃঙ্খলা সাধারণ নাগরিকেরা মেনে নিয়েছিল সুস্থ নাগরিক জীবনের আশায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর একটা টার্গেট ছিল মজুতদার আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নাটের গুরুরা। এদের চিহ্নিত করে, আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা ছিল। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা হতো সে সময়। অতি মুনাফাখোরদের ধরতে আর সিন্ডিকেট ভাঙার অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরা। যদিও এই সরকার সাংবিধানিকভাবে কোনও পলিসি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কিন্তু জবাবদিহি নিশ্চিত করার তোড়জোড় এই সরকারের মধ্যে খানিকটা ছিল। এটা যদিও কোনও জননির্বাচিত সরকার ছিল না, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জনগণের জন্য খানিকটা হলেও কাজ করে গেছেন।

ক্যানসারের মতো জেঁকে বসা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে, আজও এ দেশের মানুষ নির্বাচিত/রাজনৈতিক/সাংবিধানিক সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও জোরালো ব্যবস্থা নিতে দেখেনি। জনগণের জন্য রাজনীতির যে চর্চা হওয়া দরকার ছিল, তার পরিবর্তে মানুষ দেখেছে রাষ্ট্রীয় যাবতীয় আয়োজন চলে গেছে গুটিকয়েক সুবিধাবাদীদের দখলে। এ দেশের মানুষ আজও দেখেনি সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর ব্যবস্থা করেছে কোনও সরকার। অথচ গার্মেন্টস কর্মী, মজুর, কৃষক আর প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টের টাকা লুটপাটে মেতে ওঠে কিছু চেনা আর কিছু অচেনা লুটেরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমনটা করা সম্ভব না, এটা সবাই জানলেও, দিনের পর দিন হয় না এর কোনও প্রতিকার।

রাজনৈতিক বয়ানের উপাত্ত হিসেবে যে ‘গণতন্ত্র’, ‘সংবিধান’, ‘আইনি ব্যবস্থা’র কথা বলা হয়, সেগুলো সবই জনগণকে বোকা বানানোর উপাদান মাত্র। সৎ নেতৃত্ব আর আদর্শিক রাজনীতি ছাড়া কোনোদিন গণতন্ত্র আসে না, আসে না জবাবদিহি। তাই তো, অসাংবিধানিক হওয়া সত্ত্বেও এ দেশে কখনও কখনও সামরিক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন মেয়াদে থাকতে পেরেছে। এ দেশের মানুষের অনেক অপ্রাপ্তির হাহাকার আছে। তারপরও, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যেকোনও অভিযান দেখলে, সাধারণ মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি জাগে। সরকার কতখানি আইনশুদ্ধ, না কতটা সাংবিধানিক, এতসব কিছু নিয়ে জনগণ খুব একটা মাথা ঘামায় না। লাল দল না নীল দল, এসব নিয়ে তাদের চিন্তা থাকে না। তারা শুধু দেখতে চায়, সরকার তাদের মৌলিক চাহিদার জন্য কতটা করতে পারছে। তারা দেখতে চায়, তাদের কষ্টের টাকা, ঘুষ, ব্যাংক লুট, শেয়ার মার্কেট লুট বা কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে যেন অন্য কোথাও পাচার না হয়।    

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
দায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আজদায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
শাহীনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
শাহীনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ