X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনি প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া কতটুকু কার্যকর

খায়ের মাহমুদ
২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:৩১আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১৯:৩১

দেশের প্রধান দুটো দল পরস্পর বিপরীত মেরুতে থাকা অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও দ্বাদশ নির্বাচন বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে, বোধ করি বাংলাদেশের বিগত কোনও নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রকাশ্যে এতটা সক্রিয়তা কখনও দেখায়নি। বিএনপি এখনও বলছে তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।

যদিও সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হওয়া ছাড়া অবশিষ্ট কোনও উপায় নেই। সুতরাং বিএনপি আসুক বা না আসুক সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এবং আইনের শাসন জারি রাখতে দেশে একটি নির্বাচন অনিবার্য।

দেশে যেহেতু নির্বাচন আসন্ন, তাই এই নির্বাচনের বিভিন্ন প্রভাবক নিয়ে ভাবতে হবে বিভিন্ন দলকে, এমনকি নির্বাচন কমিশনকেও।

গত এক দশকে দেশে নতুন ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ, যার মধ্যে এবার প্রথম ভোট দিবে ১ কোটি ৫৪ লাখ, সংখ্যাটি কোনও অংশেই কম নয় বরং গত দশ বছরের নতুন করে যুক্ত হওয়া তরুণ ভোটারের সংখ্যা মোট ভোটারের প্রায় ২১ শতাংশ। তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ভোটাররা বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক ব্যবহারের অভ্যস্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না মানুষের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই। প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তার ক্ষমতাও ইতোমধ্যে প্রমাণিত। দুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিং কেন্দ্রিক ভোগান্তি নিয়ে একজন ইউটিউবারের ভিডিও দেখে দ্রুততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যসহ পুরো প্রশাসন তার সঙ্গে বসে সমস্যা শুনেছে এবং সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।

আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে স্মার্ট ফোন থাকা প্রত্যেকটা মানুষই এক একজন সাংবাদিক, যেকোনও সচেতন নাগরিক হাতে থাকা ফোন দিয়ে তুলে আনতে পারে সামনে ঘটা অসঙ্গতির চিত্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ব্যক্তিটি সচেতন না হলে বা অসৎ উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে কনটেন্ট বানালে আমাদের সেটা ট্র্যাক করা এবং নামিয়ে ফেলার প্রস্তুতি কতখানি?

যেকোনও অসত্য তথ্য বা গুজবকে দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নির্বাচন চলাকালীন এ ধরনের বড় ঘটনা ঘটলে কী করে দ্রুত সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া যায় সেই প্রস্তুতি থাকতে হবে নির্বাচন কমিশনের।

২০১৩ সালের ৫ মে’র মতিঝিলের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই আপনাদের। মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা জানতোই না ব্লগার মানে কী? তারা কী করেছে বা বলেছে? কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের ‘নাস্তিক’ গুজবে তারা তাণ্ডব চালিয়ে পুরো ঢাকাকে অচল করে দিয়েছিল; এমনকি তখন তাদের উচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করেও ছড়ানো হয়েছিল নানান গুজব। অবশ্য সেই গুজবের পালে হওয়া দিয়েছিল বিভিন্ন এনজিও, এমনকি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকে। কাল্পনিক মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করে দেশকে করা হয়েছিল অস্থিতিশীল। অসত্য ও মিথ্যা তথ্য যারা ছড়ায় তারা খুব ভালো করেই জানে কী করে সাধারণ আর সহজ সরল মানুষের মগজে গুজব ঢুকিয়ে দেওয়া যায়! আর বর্তমান সময়ে এই গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়ানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

এখন বিজ্ঞানের যুগ, আধুনিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে এই ধরনের অসত্য তথ্যের উৎস দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে। যারা এ ধরনের গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় এনে গুজব ছড়ানোর মূল উদ্দেশ্যগুলো চিহ্নিত করতে হবে। কেননা, নির্বাচনের সময় এমন বড় কোনও ঘটনা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। গবেষণা বলছে, যারা গুজব ছড়ায় তারা কোনও না কোনোভাবে তাদের মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজনীতিতে গুজব বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ইতিবাচক গুজবের পরিবর্তে নেতিবাচক গুজব সর্বদা অধিক কার্যকর হতে দেখা গেছে।

বর্তমান সময়ে বড় ছোট বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাই টুইটার-ফেসবুকে নিয়মিত বক্তব্য রাখছেন। ফেসবুক টুইটারে রাজনৈতিক নেতা ও ভোটার মধ্যে একধরনের সরাসরি যোগাযোগর সুযোগ থাকায় ভোটাররা এ মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে। রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচিত ও সমালোচিত বিষয়ে মতামত দেয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে মতভেদ আছে, তারপরও পৃথিবীব্যাপী নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার প্রমাণিত ও কার্যকর একটা মাধ্যম বলে অনেকে মনে করেন, বর্তমান সময়ে দলগুলো তার নির্বাচনি প্রচারে ব্যয়ের একটা বড় অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় খরচ করে।

২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে বিজয়ী হতে তার দলের সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। অধিক পরিচিত রাজনীতিক হিলারি ক্লিনটন হেরে গিয়েছিলেন ট্রাম্পের আগ্রাসী প্রচারণার কাছে। ট্রাম্পের বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য রাতারাতি বহুল প্রচার পায়, যা সিদ্ধান্তহীন ও অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ভোটারদের তার দিকে প্রভাবিত করেছে। ২০২০ সালে অবশ্য সেই  ট্রাম্প নিজেই রাশিয়ান এবং চাইনিজদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আগ্রাসী প্রচারের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন। ২০১৭ অনুষ্ঠিত ইউকে সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভরা ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের নির্বাচনি প্রচারণা এবং বয়সভিত্তিক বার্তা প্রচার করতে ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ২ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি খরচ করেছিল। কনজারভেটিভ এবং লেবার উভয় দলই সোশ্যাল মিডিয়াকে দারুণভাবে ব্যবহার করে তারা তাদের সমর্থকদের একত্রিত করতে পেরেছিল সেই নির্বাচনে।  

বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ শুরু করেছে তার অফলাইন ও  অনলাইন প্রচার ও প্রচারণা। বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্য যে দলগুলোই নির্বাচনে আসবে তারাও তাদের প্রচারে অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনকেও অনেক বেশি গুরুত্ব দেবে। অনলাইন প্রচারে সুবিধা হলো আপনি খুব সহজে দূরে থেকেও ভোটারদের কাছে কাঙ্ক্ষিত বক্তব্য তুলে ধরতে পারবেন, তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন। আগে ভোটের প্রচারে টেলিভিশন, রেডিও ও পত্রিকা প্রধান প্রচার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করলেও সে অবস্থা যে পরিবর্তিত হয়েছে সেটা আমরা সবাই অনুধাবন করতে পারছি। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভোটের প্রচার ও প্রচারণা কৌশলে সচেতন থাকতে হবে দলগুলোকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক মাধ্যমের এই প্রবল উপস্থিতির কিছু অসুবিধাও আছে, যা ভোটের সময় দলগুলোকে আমলে নিতে হবে। যেমন, সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় মানেই তিনি তার নিজ এলাকায় জনপ্রিয় তা কিন্তু নন। অনেকেই আছেন যারা রাজনৈতিক নেতা নন, সাধারণ মানুষের সুখে দুঃখে কখনও এলাকাতে যাননি, কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত বক্তব্য রাখছেন কিংবা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে নিয়মিত কিছু কাজ করে যাচ্ছেন, এখন দলগুলো যদি তার সোশ্যাল মিডিয়া ভিউ দেখে দলীয় নমিনেশন দেন তাহলে সেটা হবে তৃণমূল কাজ করা দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন এমন অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার থাকবেই কিন্তু ভোটের রাজনীতির মূল হলো মানুষের কাছাকাছি যাওয়া, সরাসরি ভোট প্রার্থনা করা, মানুষের সুখ ও দুঃখের কথা শোনা। গত একযুগে ভারতের নির্বাচনগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত নাম প্রশান্ত কিশোর (পি কে)।  ৪৫ বছরের এই বিস্ময়কর নির্বাচন কৌশলী যে দলের নির্বাচনি প্রচারে হাত দিয়েছেন সেখানেই সফলতা পেয়েছেন।

২০১১ সাল থেকে তার প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আইপ্যাক) ৯টি নির্বাচনের প্রচারের দায়িত্ব পায় বিভিন্ন দলের। তার মধ্যে আটটিতে তার প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগকৃত দলকে জয়ী করতে সমর্থ হন। আইপ্যাকের ৪০০০ জনের নির্বাচনে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মী বাহিনী রয়েছে, যে দলের দায়িত্ব তারা নেন প্রথমেই মাঠ পর্যায়ে সেই দলের শক্তি এবং দুর্বলতা তারা চিহ্নিত করেন। যেমন, ২০১৫ সালের বিহার নির্বাচনে তারা প্রায় ৪০ হাজার গ্রামে গিয়েছিল, মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তুলে এনেছিল নির্বাচনে নতুন সরকারের কাছে তারা আসলে কী চায়। প্রশান্ত কুমারের সেই অফলাইন বা সরাসরি ভোট প্রার্থনা পরিকল্পনাতেই জনপ্রিয়তার তলানিতে থাকা জনতা দলের নীতিশ কুমার তৃতীয়বারের মতো মুখ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন। খুশিতে নীতিশ কুমার প্রশান্তকে বানিয়েছিলেন তার উপদেষ্টা।

প্রশান্ত কুমার বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ১০ বছর ধরে ল্যাপটপ ব্যবহার করেন না, ইমেইল করেন না, পত্রিকা পড়েন না, তার কাজে শুধু একটা মোবাইল ব্যবহার করেন আর মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেন, জীবনকে কাছে থেকে দেখেন।

সুতরাং উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে নির্বাচনি প্রচারণায় অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক প্রচারণা সফলতা পেলেও ভারত বা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক অধিক নির্বাচনি প্রচারণা সফলতা নাও পেতে পারে। অন্তত ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলা যায়, এখানকার সাধারণ মানুষ এখনও চায় শুধু নির্বাচনের সময় হলেও একজন প্রার্থী তার বাড়িতে আসুক, তার কাছে সরাসরি ভোটটি প্রার্থনা করুক, ভোটার হিসেবে সে তার প্রার্থীকে সরাসরি দেখুক, জানুক।  

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের মণিপুরে আবারও জাতিগত সহিংসতা
ভারতের মণিপুরে আবারও জাতিগত সহিংসতা
বাংলা গানের উন্নয়ন ও বিকাশে ‘অংশীজন সভা’
বাংলা গানের উন্নয়ন ও বিকাশে ‘অংশীজন সভা’
দায়িত্ব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যা বললেন র‍্যাবের নতুন মুখপাত্র
দায়িত্ব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যা বললেন র‍্যাবের নতুন মুখপাত্র
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ