X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী থেকে স্বতন্ত্র: নির্বাচনি রাজনীতির নতুন মাত্রা

মোস্তফা হোসেইন
০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১৮আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১৮

২০২৪-এর নির্বাচনে রাজনীতিতে বড় কোনও বাঁকবদল হয়ে যাবে, এমনটা বলা যায় না। আবার এমনও বলার সুযোগ কম যে নির্বাচনটি হবে ২০১৪ কিংবা ২০১৮-র মতো। নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট সতর্ক এই ব্যাপারে। একই সঙ্গে সরকারের সামনেও বড় রকমের চ্যালেঞ্জ একটা। চ্যালেঞ্জটা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকেই। রাজনীতির মাঠে সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখে মনে করার কোনও কারণ নেই ভোটে জয়ের জন্য সরকার অতীতের পথে হাঁটবে। কারণ, বিগত নির্বাচনে আইনগতভাবে জয়ের মুখ দেখলেও দুর্নামও জুটেছে আওয়ামী লীগের।

২০১৪-এর নির্বাচনের মতো এবারও বিএনপি অংশগ্রহণ করছে না। অন্যদিকে ২০১৩-২০১৪ সালে যেভাবে দেশে অগ্নিসন্ত্রাস চলেছিল, এবারও সেভাবেই চলেছে। তবে সেই তুলনায় প্রাণহানি ঘটেছে কিছুটা কম। তবে প্রাণহানির সংখ্যা কম হলেও তা কখনও কাঙ্ক্ষিত নয়। তফসিল ঘোষণার আগে যেভাবে বিরোধী দল রাজনৈতিক মাঠ গরম করে রেখেছিল, তাতে নির্বাচনকে ঘিরে যে আতঙ্ক হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই মুহূর্তে আশা করা যায় সেরকম কিছু নাও ঘটতে পারে।

আগের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ বলতে গেলে এককভাবে নির্বাচন করেছে। দুয়েকটি ছাড়া ক্ষুদ্র দলগুলো কেউ কেউ নৌকা মার্কা নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এবারের পরিস্থিতি ২০১৪ সালের মতো হলেও আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ তাদের দল থেকে কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচন করে তাহলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে। তার মানে আগে যেভাবে মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ নির্বাচন করলে তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হতো, এবার সেটা হচ্ছে না। বরং দলের সাধারণ সম্পাদক বলে দিয়েছেন, বিদ্রোহীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়াটা নির্বাচনি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন তারা।

বিশ্লেষকদের মন্তব্য– আসলে সরকারের সামনে নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অংশ এটা। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না এবং বিএনপি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শক্তিশালী দলও মাঠে নেই, মোট কথা হচ্ছে– নির্বাচনে যেহেতু বড় দল হিসেবে শুধু আওয়ামী লীগই থাকছে, তাই ভোটারদের উৎসাহে ভাটা পড়তে পারে। যা গত নির্বাচনগুলোতে প্রত্যক্ষ করা গেছে। গত নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার এটাও একটা বড় কারণ। গত নির্বাচনের পর অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে ৩৪%-৩৫% ভোট থাকার পরও নির্বাচনে ১৫%-২০% ভোট পড়েনি কেন। সমালোচকরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, আওয়ামী লীগের ভোট কোথায় গেলো। আওয়ামী লীগ বিরোধীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করেছে সরকারবিরোধী প্রচারণায়। যদিও এই বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণা চালিয়েও আওয়ামী লীগ বিরোধীরা সেই হাতিয়ারটি কাজে লাগাতে পারেনি। এটা তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা।

অবস্থা বুঝে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সেই সুযোগটি নিতে দেবে না আগামীতে। যে কারণে আওয়ামী লীগ নিজেদের নেতাকর্মীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের এই নয়া কৌশল পরবর্তী অবস্থাটা কী হতে পারে তা বিগত কিছু নির্বাচনের আলোকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০১৯ সালে ১৭০ জন প্রার্থীই ছিল মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। ২০২৪ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত ১২ জন এমপি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৫৮ জন নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগার। ৭১ জন এমপি মনোনয়ন পাননি এবার। তিন হাজারের বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকে আছেন দলের নমনীয়তাকে ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। ফলে প্রতিটি আসনে প্রার্থীর সংখ্যা অনুমানের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের উন্মুক্ত সুবিধা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এবং অধিক সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। যা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দুটি প্রধান শর্ত পূরণ করবে। এদের সঙ্গে ক্ষুদ্র দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টি তো আছেই। জোট সুবিধা যারা পাবে তাদের বাইরে অন্য সদস্যদের ক্ষেত্রেও মনে করা যায় তারা অনেকেই নির্বাচন করবেন। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের যেমন রিলাক্স ব্যবস্থা হচ্ছে তেমনি তাদের বেলাতেও তেমনি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে জোটভুক্ত ছোট দলগুলোরও জোট মনোনীত প্রার্থীর বাইরে আরও প্রার্থীর নির্বাচন করার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

বাদ পড়া এমপি এবং মনোনয়ন বঞ্চিত স্থানীয় নেতাদের এই সুযোগদান আগামীতে নির্বাচনি সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আগামীতেও যদি মনোনয়ন বঞ্চিতরা এভাবে স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন কি এই দলটি সামাল দিতে পারবে? নির্বাচন শেষে যদি ঘরোয়া নির্বাচন হিসেবে এটিকে আখ্যায়িত করা হয় তখনও কি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না?

এসব বিবেচনা করে বলা যায়, ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচন রাজনীতির বড় কোনও নতুন বাঁকবদল না করতে পারলেও নির্বাচনি রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। তবে সেই মাত্রাটা আসলে সুস্থ রাজনীতির জন্য কতটা সহায়ক হবে সেটা বলা যাবে আগামী সময়ে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন ৩৩৬২ জন। সেই হিসাবে বঞ্চিত হয়েছেন ৩০৬৪ জন। এরমধ্যে ১০% জনও যদি স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে মনোনীত প্রার্থীর সমান হয়ে যাবে প্রায়। উপজেলা নির্বাচনকে যদি তুলনায় আনা হয় তাহলে এমন হওয়া অসম্ভবও নয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচন পরবর্তীকালে তাদের পরিচিতি সংকটে পড়তে হবে কমবেশি। তবে অনেকেই মনে করছেন, মনোনয়ন বঞ্চিতদের অনেকেই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। এমনকি কেউ কেউ এমনও মনে করছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলো থেকে নির্বাচিতদের চেয়ে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্বাদশ সংসদে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিও নতুন হিসেবে গণ্য হবে।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। যদিও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য হওয়ায় তাকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। তিনি একাধিকবার প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করায় এই বিষয়ে আর সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা আমাদের নির্বাচনি ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে থাকেন। গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিকভাবেও তাদের পরিচিতি হয় বিদ্রোহী হিসেবে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় স্বীকৃতি দেওয়ায় নতুন পরিচিতি হচ্ছে স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ। এটাও এই নির্বাচনের নতুন একটি দিক।

সবশেষ কথা হচ্ছে– দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচন নতুন পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে এটা বলা যায়। তবে সেটা আমাদের রাজনীতিতে গুণগত মানের কী পরিবর্তন আনবে তা ভবিতব্য।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে বিএনডিপি ডিবেটার হান্ট ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা
উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে বিএনডিপি ডিবেটার হান্ট ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সদস্য হলেন কাজী নাবিল আহমেদ ও সেলিম মাহমুদ
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সদস্য হলেন কাজী নাবিল আহমেদ ও সেলিম মাহমুদ
ফুরফুরে মেজাজে পান্নু
ফুরফুরে মেজাজে পান্নু
টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু
টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ