X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বতন্ত্ররাই ঠিক করুক বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন 

খায়ের মাহমুদ 
১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:১৩আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:১৩

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল কারা হবে এবং বিরোধী দলীয় নেতা কে হবেন, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের পর সবচেয়ে বেশি ৬২টি আসন পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা ব্যক্তিরা, এর বাইরে জাতীয় পার্টি ১১ টি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের একজন করে ২ জন নির্বাচিত হয়েছেন, তবে এই দু’জন নিজেদের দলের প্রতীক ছেড়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং আওয়ামী লীগের বাইরে নিবন্ধিত দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিতেছে এমন দল তিনটি জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ। 

সংকটের বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের আইনে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু নেই, এক্ষেত্রে প্রচলিত রীতিটি হচ্ছে সংসদে নির্বাচিত দলগুলোর মধ্যে আসন সংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দলই প্রধান বিরোধী দল এবং ওই দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যাকে নেতা নির্বাচিত করবেন, তিনিই বিরোধী দলীয় নেতার আসন পাবেন। দেশের সংবিধান বা কোনও আইন-বিধিতে বিরোধী দল ইস্যুতে কোনও নির্দেশনা নেই, কেবল সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘বিরোধী দলীয় নেতা’ কথাটি উল্লেখ রয়েছে।

কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট) ধারা অনুযায়ী, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’

কাজেই শুধু দল হিসেবে ১১ জন সংসদ নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেছে এই কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ তাদের থেকে সংখ্যায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যদি কোনও মতানৈক্য পৌঁছাতে পারেন এবং একটি মোর্চা বা সংসদীয় ককাস গঠন করে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, সেক্ষেত্রে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট) ধারা অনুযায়ী স্পিকার তাদের নেতাকে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন। 

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সব থেকে আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি ছিল মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরব উপস্থিতি। ভোটের মাঠে তারা লড়ছেন সমানে সমান, ফলাফল অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের হেভিওয়েট প্রার্থীরা। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ একাধিক দলের প্রার্থীকে পাশ কাটিয়ে নির্দলীয় একজন প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন, সেই প্রার্থীর বোঝা উচিত তার মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা তাকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে বড় দল ও প্রতীকের থেকে ওপরে নিয়ে গেছে। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের উচিত তার প্রত্যেকটি ভোটারের ভোটের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সরকারি দলে ভীড়লেই যে তারা মূল্যায়িত হবেন বা লাভের গুড়ে ভাগ পাবেন তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোট বাংলাদেশে আগেও হয়েছিল।

২০১৪ সালে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জোটবদ্ধ হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে ৩টি আসন পেয়েছিলো, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা জোট ভেঙে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন এবং আমার বিশ্বাস অন্য যেকোনও বারের তুলনায় এবার অনেক বেশি যোগ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। তাই দ্বাদশ সংসদের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোটবদ্ধ হতে পারলে সংখ্যার বিচারে তারা প্রায় ১০টির বেশি সংরক্ষিত মহিলা আসনে মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারবেন, সেক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা ৭২ বা তার ওপরে চলে যেতে পারে, যা একটি চমৎকার, কার্যকর ও প্রাণবন্ত সংসদ উপহার দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

আমাদের বাস্তবতায় বিরোধী দল বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে, আমরা অধিকাংশই মনে করি সংসদের বিরোধী দল মানে তার কাজ সব কিছুতে বিরোধিতা করা, সংসদ বর্জন করা এবং ধ্বংসাত্মক প্রতিবাদে জড়িয়ে পড়া। সময় এসেছে আমাদের সেই পুরনো জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরোধী রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার। আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে দেশে সুষম উন্নয়ন করেছে। 

সুতরাং সংসদের বিরোধিতা করলে আপনার এলাকায় কাজ হবে না, শেখ হাসিনা সেই রাজনৈতিক ধারাকে বদলে দিয়েছেন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। 

গত দুটো সংসদে বিরোধীদল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল সরকারের আজ্ঞাবহ বিরোধী দলের মতো, সুতরাং ১১ জন সদস্য নিয়ে সেই জাতীয় পার্টি যদি এবারও প্রধান বিরোধী দল হয় তবে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। বরং জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হওয়ার থেকে সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল না থাকাই ভালো। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংসদে বিরোধী দল হতে হলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন পেতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী ও পৃথিবীর বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতে গত ১০ বছর সংসদে কোনও প্রধান বিরোধী দল নেই। ভারতে সংসদের দুই কক্ষেই প্রধান বিরোধী দল হতে হলে আসন সংখ্যায় দ্বিতীয় দলকে মোট আসনের ১০ শতাংশ আসন পেতে হয়, তাও এককভাবে কোনও কোনও জোট বা কোয়ালিশন গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, লোকসভায় বিরোধী দল হতে হলে মোট আসনের ১০ শতাংশ মানে ৫৫ টি আসন পেতে হয়, বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য একটা ব্যবস্থা মনে হয়।

আমাদের দেশে চলমান হাতে গোনা ১০/১১ টি আসন নিয়ে সংসদে স্বীকৃত প্রধান বিরোধী দল হওয়া এবং নাম সর্বস্ব বিরোধী দল হিসেবে সময় পার করা ও প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে মন্ত্রী পদমর্যাদা উপভোগ বন্ধ হওয়া উচিত। 

গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় সংসদ হোক সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, সরকারের সকল সিদ্ধান্তে সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা হোক, জাতি জানুক দেখুক কীভাবে কী হচ্ছে। একটি সক্রিয় বিরোধী দল থাকুক যারা বিরোধী দল হিসেবে সরকারের নীতি-নির্ধারণের ওপর নজরদারি করবে, জনগণের স্বার্থ রক্ষা জন্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে; সরকারের বিভিন্ন আইন, বিল, বাজেট ইত্যাদির প্রয়োজনীয় সমালোচনা করবে এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো জনগণের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা খতিয়ে দেখবে।

বিরোধী শক্তি যদি সরকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে প্রতিবাদ করে এবং জনগণের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে তবে ঠিক যেভাবে শূন্য থেকে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ঠিক তেমনই খুব সহজেই তারা নিজেদেরকে বিকল্প সরকারের ভূমিকা নিয়ে আসতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। সুতরাং স্বতন্ত্ররাই ঠিক করুক বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধান বিরোধী দল এবং নেতা কে হবেন। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
ঘনঘন শ্যাম্পু ব্যবহারে চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন সমাধান
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাতে নিহত ৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ