X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

খেজুর ও বরই বিতর্ক

আমীন আল রশীদ
১২ মার্চ ২০২৪, ২১:৫০আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৪, ২২:৫০

কোনও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে সেটি না খাওয়ার ‘সহজ পরামর্শ’ দেওয়া নতুন কিছু নয়। যেমন, গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেলে বলা হয় গরুর মাংসে কোলেস্টেরল বেশি। অতএব না খাওয়াই উত্তম। মুরগির দাম বেড়ে গেলে বলা হয় ডাল খান। ডাল হচ্ছে গরিবের আমিষ। পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে বলা হয় পেঁয়াজ ছাড়াও রান্না হয়, ইত্যাদি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতারের পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

গত ৪ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের একটি অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মন্ত্রী বলেন, ‘বরই দিয়ে ইফতার করেন না কেন? আঙুর-খেজুর লাগবে কেন? আপেল লাগবে কেন? আর কিছু নেই আমাদের দেশে? পেয়ারা দেন না, সবকিছু দেন। প্লেটটা ওভাবে সাজান। ইফতার পার্টি তো বলেই দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দরকার নেই। কাজেই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আপনার সংসারে যেমন আপনি দেখেন, এইভাবে দেশটারেও দেখেন আপনারাও সাংবাদিকরা। আকাশ থেকে খালি দেখেন না, নিচের থেকে এসেছেন আপনারাও। সেগুলোও দেখেন, আশপাশে দেখেন।’

তবে শিল্পমন্ত্রীর এই পরামর্শে চটেছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বলেছেন, ‘আমি বরই দিয়ে ইফতারি করবো, আর তুমি খেজুর-আঙুর খাবা?’ ইনু বলে, ‘সাহস থাকে তো খেজুর আর আঙুরের আমদানি নিষিদ্ধ কর। খেজুর আর আঙুর আমদানি করবা, গরিব মানুষ বরই খাবে, তুমি আঙুর আর খেজুর খাবা, তা হবে না, তা হবে না।’ 

শুধু তাই নয়, খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দেওয়ায় নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ারও আহ্বান জানান ইনু।

ইফতারের আইটেমে খেজুর যে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো তার প্রধানত কারণ ধর্মীয়। যেহেতু আরবের প্রধান ফল খেজুর, যেটি অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্যও বটে এবং মহানবী (সা.) খেজুর খুবই পছন্দ করতেন, খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, ফলে সারা বিশ্বে ‍মুসলমানদের কাছে খেজুর দিয়ে ইফতার করা পুণ্যের কাজ। দ্বিতীয়ত খেজুরের পুষ্টিগুণও অনেক। পুষ্টিবিদরাও বলে থাকেন যে সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে খেজুর সবচেয়ে উপকারী। প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকায় রোজা শেষে ইফতারিতে খেজুর খেলে দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করা যায়। সেই সাথে দ্রুত দুর্বলতাও কেটে যায়। যার সাথে অন্য কোনও খাবার বা ফলের তুলনা চলে না। ফল কিংবা খাদ্য হিসেবে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প হতে পারে না।

প্রশ্ন হলো, শিল্পমন্ত্রী খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই খেতে বললেন কেন? এই দুটি ফল দেখতে কাছাকাছি বলে? অথবা হতে পারে তিনি খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রতীকী অর্থে।

অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন তার আরেকটি অর্থ হলো: ‘খেজুর না খেলে কী হয়?’ অর্থাৎ পরামর্শটা গরু ও মুরগির মাংস এবং পেঁয়াজের বিকল্প কিংবা পেঁয়াজ না খাওয়ার পরামর্শের মতো। অর্থাৎ এটা না খেলে কী হয়, ওটা না খেলে কী হয় ইত্যাদি।

প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাবে আর সেটি না খাওয়া কিংবা তার বিকল্প পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কিংবা সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি কেন ওই জিনিসটির দাম বেড়ে গেলো তার ব্যাখ্যা দিতেন এবং সেই পণ্যটি সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে নিয়ে আসতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, সেই তথ্যটি মানুষকে জানাতেন, তাহলে ভালো হতো। কেননা, তাদের মনে রাখা দরকার, কোনও কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে উৎপাদন সংকটজনিত জটিলতার বাইরেও রাষ্ট্রীয় নীতিও অনেক সময় ভূমিকা রাখে—যেমন খেজুরের বেলায় হয়েছে।

সরকার খেজুরকে ‘বিলাস দ্রব্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে এর আমদানি শুল্ক বেড়েছে। খেজুরের মতো একটি পণ্য কী করে বিলাস দ্রব্য হয়, সেটি বিরাট প্রশ্ন। হতে পারে এর দামের কারণে। সরকার হয়তো ভেবেছে যে ফলের কেজি ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা বা তারও বেশি, সেই ফল স্বল্প আয়ের মানুষ খাবে না, অতএব এটা বিলাস দ্রব্য—সেটি হয়তো একটি যুক্তি। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে রোজার মাসে রোজাদারমাত্রই ইফতারি এমনকি সেহরিতেও খেজুর খেতে চান। হাজার বছর ধরে সেহরি ও ইফতারের মেন্যুতে খেজুর ছিল। অভিযোগ উঠেছে, খেজুরের শুল্কহার বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে একদিকে যেমন খেজুরের দাম বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকট। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের যে অতি সাধারণ প্রবণতা, সেটি হলো, যেকোনও অজুহাতে তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেন।

সম্প্রতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এই ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী তথা মজুতদারদের গণধোলাই দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশে খেজুর মূলত আমদানিনির্ভর এবং নানা জাতের নানা দামের খেজুর আসে। দুইশ’ টাকা বা তারও কম দামি খেজুর যেমন আসে, তেমনি কয়েক হাজার টাকা কেজি দরের খেজুরও বাজারে পাওয়া যায়। আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী মানুষ খেজুর কিনে থাকেন। রাজধানীতে খাদ্যপণ্যের অন্যতম বড় বিপণিকেন্দ্র কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজার মাসে সাধারণত তিনশ’ থেকে ছয়শ’ টাকা কেজির খেজুরের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এবার সেই ছয়শ’ টাকা কেজির খেজুরই বিক্রি হচ্ছে নয়শ’ থেকে এক হাজার টাকায়।

খেজুর না খেলে কী হয় বা ইফতার ও সেহরিতে এই বিদেশি ফল রাখতেই হবে কেন— এই সরল প্রশ্ন করা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে সংকটের সমাধান হবে না। কেননা ধর্মীয় অনুভূতির কারণে হোক আর পুষ্টিগুণের কারণে হোক, রোজার মাসে মুসলমানরা খেজুর খেতে চাইবেই। সে কারণে সরকারের উচিত ছিল অন্তত এই মাসের জন্য খেজুরে আমদানি শুল্ক আরোপ না করা এবং প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে খেজুর আমদানির জন্য একটা কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া যাতে বিনা শুল্কের ‍সুযোগ নিয়ে কেউ অতিরিক্ত খেজুর আনতে না পারেন। এখানে বাজার মনিটরিং জোরদার করা। তাতে করে শিল্পমন্ত্রীকে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে একজন সাবেক মন্ত্রীর তোপের মুখে পড়তে হতো না। তাতে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ট্রলের শিকার হতেন না। তিনি খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শটি হয়তো সৎ উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন, তাতে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও সামনে চলে এসেছে।

কোনও কিছুর দাম বেড়ে গেলেই সেটি না খাওয়া বা সেটির বিকল্প বলতে গিয়ে অনেক সময় যে হাস্যকর পরামর্শ দেওয়া হয়—সেই ধারাবাহিকতায় খেজুরের বিকল্প বরই হতে পারে কী পারে না, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে?

বাংলাদেশে যেহেতু অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করে রাতারাতি ধনী হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে, ফলে এখানে বাজারের প্রধান সংকট হলো সৎপথে সীমিত আয়ের লোকটিকেও বাজারে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় অবৈধ পথে উপার্জনকারী পয়সাওয়ালার সঙ্গে। যে মাছের দাম এক হাজার টাকাও আপনার পছন্দ হলো না, সেটি আরেকজন এসে দেড় হাজার টাকায় কিনে নিয়ে গেলেন কোনও দরদাম ছাড়াই। ফলে আপনি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। অতএব খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই কতটা উপযুক্ত, এমনকি বরই না খেলেও কী হয়—সেই কথাও যদি বলা হয়, তারপরও যে প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি তা হলো, মুক্তবাজার অর্থনীতির এই দুনিয়ায় সৎপথে উপার্জনকারী সীমিত আয়ের মানুষটি তার পছন্দের জিনিসটি কিনতে পারছেন কিনা এবং না পারলে তার যে দীর্ঘশ্বাস—রাষ্ট্র সেটি শুনতে পাচ্ছে কিনা বা শুনতে চাচ্ছে কিনা?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ