X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে স্কুল খোলা রাখা, রাজনীতি ও একটি রিট

এস এম আববাস
১৩ মার্চ ২০২৪, ১৩:৪৫আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪, ১৩:৪৫

বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় রোজার পুরো মাসজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কোনও নজির নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে রমজানের প্রথম কয়েক দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সরকারি নির্দেশনা গড়ায় উচ্চ আদালতে। পুরো রমজান মাস ছুটি চান শিক্ষকরা, এমন কথাও অনেকেই বলছেন। কিন্তু কেন পুরো রমজান মাস ছুটি প্রয়োজন?

শিক্ষাপঞ্জিকা সংশোধন করে বিদ্যালয় রমজানের শুরুতে খোলা রাখা এবং তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় দেখে শুরুতে মনে হয়েছিল ঠিকঠাক ধর্ম পালনের জন্য এমন দাবি করছেন একশ্রেণির শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষাপঞ্জিকা সংশোধনের এক মাস পর রমজান শুরুর ঠিক দুদিন আগে গত ১০ মার্চ উচ্চ আদালতে রিট করার পর মনের মধ্যে খটকা লাগে। বারবার মাথায় ঘুরপাক চলতে থাকে, এ নিয়ে রাজনীতি নেই তো?

এবার সময়গুলো মিলিয়ে দেখি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকা বা শিক্ষাপঞ্জিকা আংশিক সংশোধন বা পরিবর্তন করা হয় গত ৮ ফেব্রুয়ারি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় রমজানের প্রথম ১৫ দিন (২৫ মার্চ পর্যন্ত) এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় রমজানের প্রথম ১০ দিন (২১ মার্চ পর্যন্ত) খোলা রাখার নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নির্দেশনার এক মাসের বেশি সময় পর গত ১০ মার্চ হঠাৎ করেই একটি রিট আবেদন দাখিল করা হয় উচ্চ আদালতে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, কেন আরও আগে রিট আবেদন করা হলো না? কেন রোজা শুরুর দুদিন আগে রিট করা হলো?

এই খটকা দূর করতে হলে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর ব্যাখ্যা আগে জানা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর বলছে— শিক্ষার্থীরা যাতে শিখন ঘাটতিতে না পড়ে সে কারণেই রমজানের শুরুতে কয়েক দিন বিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন ঘণ্টা হিসাব করে বিদ্যালয় খোলা রাখা প্রয়োজন ১৮৫ দিন। সেই হিসাব ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করা হলেও শীতের কারণে ছুটি দেওয়ায় হিসাব আর ঠিক থাকেনি। সে কারণে শিখন ঘণ্টা ঠিক রাখতে শিক্ষাপঞ্জি সংশোধন প্রয়োজন পড়ে।

রমজানে ছুটি ধর্মীয় প্রয়োজনে নাকি রাজনীতির কারণে?

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় রমজান মাসজুড়ে ছুটি দেওয়া হয় না। শুধু ঈদের ছুটি দেওয়া হয়। শুধু সৌদি আরব অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি ছুটি দিয়ে থাকে। এ বছর সৌদি আরবে ঈদসহ রমজানে ছুটি রয়েছে ১৮ দিন। এছাড়া ইরানে ২ দিন, পাকিস্তানে ৩ দিন, মালয়েশিয়ায় ৪ দিন, তুরস্কে ৫ দিন, মিসরে ৯ দিন, আফগানিস্তানে ৭ দিন ছুটি রয়েছে ঈদের ছুটিসহ। অথচ বাংলাদেশে পুরো রমজান মাস এবং ঈদের পরদিন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেয় সরকার। এ বছর শীতের ছুটির কারণে এবং নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বিবেচনায় রমজানের শুরুতে মাত্র কয়েক দিন ছুটি না দিয়ে বিদ্যালয় খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ‘মাত্র কয়েক দিন’ বলছি এ কারণে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ১০ দিন বিদ্যালয় খোলা রাখার নির্দেশনা রয়েছে এর মধ্যে চারদিন রয়েছে সাপ্তাহিক ছুটি। আর একদিন ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবসের ছুটি। অর্থাৎ রমজানের শুরুতে মাত্র ৭ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখতে হবে। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৫ দিন ছুটির মধ্যে চারদিন সাপ্তাহিক ছুটি আর একদিন জাতীয় শিশু দিবসের ছুটি। অর্থাৎ রমজানে মাত্র ৮ দিন বিদ্যালয় খোলা থাকবে। মাত্র এই কয়েকটা দিন বিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি একশ্রেণির শিক্ষক।

রমজানে বিদ্যালয় খোলা রাখায় রাজধানীতে যানজট বাড়ার আশঙ্কায় অভিভাবকসহ অনেকে ছুটির বিষয়টিকে দেখেছেন নেতিবাচকভাবে। তাহলে কী শুধু যানজটের কারণেই বিদ্যালয় খোলা রাখার বিরোধিতা? বিষয়টি কীভাবে দেখছে শিক্ষা প্রশাসন?

যানজট কমাতে কি রমজানে ছুটি আবশ্যক?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দু-একটি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রমজানে বিদ্যালয় খোলা থাকলে রাজধানীতে অসহনীয় যানজট দেখা দেবে। তাহলে প্রশ্ন, অন্যান্য সময়ে কি যানজট সহনীয় পর্যায়ে থাকে? তাছাড়া রাজধানীতে যানজট নিরসনের জন্য কি সারা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্য করা উচিত?

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেছেন, রাজধানীতে যানজট এড়াতে রমজানজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে রাজধানীর বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য বৈষম্য সৃষ্টি। তাছাড়া উপকূলে যখন সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় হয় তখন কি উপকূলের বিদ্যালয়গুলোর বন্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজধানীর বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়? তা তো হয় না।

দেশের ৫ শতাংশ মানুষের সুবিধার জন্য দেশের বাকি মানুষের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়, যা উচিত নয়।

আগেও কি রমজান মাসজুড়ে ছুটি ছিল?

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, রমজান মাসে বিদ্যালয় কখনও বন্ধ থাকেনি। শুধু শব-ই কদর ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ছুটি দেওয়া হতো। পরে রাজধানীতে যানজট কমাতে রমজানে ছুটি বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে আবার পুরো রমজান মাসে ছুটি দেওয়া হয়।

২০১৪ সালের শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, রমজান, জুমাআতুল বিদা, শব-ই কদর ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০ থেকে ২৯ জুলাই ১৯ দিন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন বন্ধ ছিল। কিন্তু ওই বছর ২৪ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটি ১৫ দিন এগিয়ে নিয়ে ছুটি দেওয়া হয়, ২৯ জুন থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ ঈদের ছুটিসহ রমজান মাসজুড়ে ছুটি ঘোষণা করা হয় সরকারিভাবে। কোভিড-১৯-এর কারণে শিখন ঘাটতি কমাতেও রমজানে বিদ্যালয় চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে যানজটের কারণে আবার বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে

এসব তথ্য বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশে রমজান মাসে একদিনও বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত মানতে চান না একশ্রেণির শিক্ষক এবং একশ্রেণির মানুষ। যেখানে সৌদি আরবেও মাসজুড়ে ছুটি নেই, সেখানে বাংলাদেশে রমজান মাসকে ঘিরে কেন এত বেশি ছুটি চাওয়া হচ্ছে? বিষয়টি ধর্ম পালনের জন্য নাকি ধর্মীয় রাজনীতির অনুপ্রেরণা? বিষয়টি নিয়ে সচেতন মানুষদের যেমন ভাবা দরকার, তেমনি সরকারেরও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আর সরকার সে কারণেই রমজানে বিদ্যালয় খোলা রাখার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিটের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

যদিও ১২ মার্চ আপিল শুনানির পর স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্তই বহাল রয়েছে। তবু শিক্ষকরা পুরো রমজানে ছুটি চান অথচ রিট হচ্ছে অভিভাবকদের পক্ষে। এসব বিষয় সরকারের নজরে থাকা জরুরি বলে আমার মনে হয়।

 
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৯
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৯
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
তিন মাঠে সাকিব, মোসাদ্দেক, জাকিরের তাণ্ডব
তিন মাঠে সাকিব, মোসাদ্দেক, জাকিরের তাণ্ডব
খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান প্রধান বিচারপতির
খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান প্রধান বিচারপতির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ