X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেলিম ওসমানদের ‘ইনডেমনিটি’ দেওয়া হয়েছে!

গোলাম মোর্তোজা
১৮ মে ২০১৬, ১৪:১৭আপডেট : ১৮ মে ২০১৬, ১৪:৪৮

গোলাম মোর্তোজা ঘটনা-এক:
১৯৭১ সালের মে মাস। শেরপুর কলেজের প্রভাষক আবদুল হান্নানকে অপমান-অসম্মান করেছিল যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার বিরুদ্ধে আনা ৭টি অভিযোগের মধ্যে এটিও ছিল একটি। এই শিক্ষকের মুখে চুন-কালি মেখে সারা শহর ঘুরিয়েছিল কামারুজ্জামানরা। এই অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
ঘটনা-দুই:
২০১৬ সালের মে মাস। শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ‘উঠবস’ করিয়েছে এমপি সেলিম ওসমান। (অনেক গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে ‘সাংসদ সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে শিক্ষককে কান ধরে ‘উঠবস’করানো হয়েছে’- বিনয়ের সঙ্গে বলি, তথ্যটি সঠিক নয়। শুধু উপস্থিতিতে নয়, সেলিম ওসমানের পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধানে এবং নির্দেশনায় শিক্ষককে কান ধরে 'উঠবস' করানো হয়েছে। ভিডিওচিত্র তা প্রমাণ করছে।)
লাঞ্ছনা-অপমান-অসম্মান করার মধ্যেই থেমে থাকেনি এমপি সেলিম ওসমান। ব্যাকডেটে তাকে শিক্ষকতা পদ থেকে বহিষ্কার করিয়েছে স্কুল পরিচালনা কমিটিকে দিয়ে।
এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু কথা।
ক. ১৯৭১ সালের যে অপরাধের কারণে কামারুজ্জামানের ১০ বছরের জেল হলো, তেমন বা তার চেয়েও বেশি অপরাধের ঘটনা ঘটলো ২০১৬ সালে! ঘটনাটি ঘটালো সেলিম ওসমান, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। নামে জাতীয় পার্টি করলেও সে বা ওসমান পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আশীর্বাদপুষ্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেই সে কথা বলেছেন।
খ. যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো সাহসী এবং প্রশংসনীয় কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সময়ে শিক্ষক অসম্মানের এমন ঘটনা ঘটে কী করে? ঘটলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?

গ. আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার বিচারের কথা যখন বলছেন, তখন সে কী করে লাঞ্ছিত শিক্ষককে বহিষ্কার করাতে পারে? এত সাহস-দাম্ভিকতা করার সুযোগ তাকে দেওয়া হবে কেন, হচ্ছে কেন?

ঘ. সেলিম ওসমান তথা ওসমান পরিবার মনে করে তাদের ‘ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি ' দেওয়া হয়েছে। তারা আইনের ঊর্ধ্বে, সত্যিকার অর্থেই ঊর্ধ্বে। তাই যদি না হবে, আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে, সে তার দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতে পারত না।

আরও পড়তে পারেন: চার কারণ দেখিয়ে ব্যাক ডেটে বরখাস্ত!

২.

শুধু এই শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা নয়। তাদের কোনও অপকর্মেরই বিচার হয় না, তদন্ত হয় না বা হলেও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

দখল-চাঁদাবাজি-মাস্তানি-হত্যা সব অভিযোগই এই পরিবারটির বিরুদ্ধে আছে। পুরনো অনেক প্রসঙ্গ না এনে শুধু ত্বকী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে পুরনো তথ্যটি আবারও বলছি। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাব তদন্ত করেছিল। সেই তদন্তে দু’জন আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল। সেখানে তারা ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরি ওসমানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় কিভাবে ত্বকীকে অপহরণ-হত্যা করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। কখন কোথা থেকে ত্বকীকে অপহরণ করা হয়, কোন গাড়িতে কারা কোথায় নিয়ে যায়, নির্যাতন করে হত্যা করে, কোন গাড়িতে, কোথায়, কারা ত্বকীর লাশ ফেলে দেয়,পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে স্বীকারোক্তিতে। র‌্যাব আজমেরি ওসমানের টর্চার সেল সনাক্ত করে, রক্তমাখা শার্ট, লাঠিসহ আরও অনেক আলামত জব্দ করে। তদন্ত শেষ, চার্জশিট দেওয়া হবে- র‌্যাবের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

তারপরও চার্জশিট দেওয়া হয়নি। ত্বকী হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। আজমেরি ওসমান কিছু দিন পলাতক থেকে আবার নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসেছে। বাহিনী নিয়ে বিচরণ করছে।

কোনও পরিবারকে যদি ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দেওয়া না হয়, এমন কিছু করতে পারে?

আরও পড়তে পারেন: জাতি ক্ষমা চাচ্ছে সেই শিক্ষকের কাছে!

আইনমন্ত্রী বলছেন, সেলিম ওসমান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে, কান ধরে ‘উঠবস’ করিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছে। আর নারায়ণগঞ্জের এসপি বলছেন, না এটা ফৌজদারি অপরাধ নয়। তাহলে এটা কোন প্রকৃতির অপরাধ? একজন এসপি এমন কথা বলতে পারেন? পারেন, কারণ এসপি জানেন যে সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে তিনি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন না।

সেলিম ওসমান জানেন মন্ত্রীদের কথাকে পাত্তা না দিলে তার কিছু হবে না।

৩.
সেলিম ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে ধিক্কার এখন সারা দেশে দৃশ্যমান। যদিও আমি ‘কান ধরে’ বিষয়ক প্রতিবাদ করা প্রতিবাদের সঙ্গে একমত নই। নিজের কান নিজে ধরতেও রাজি নই। রাষ্ট্রযন্ত্র কিছু করুক বা না করুক, অপরাধী সেলিম ওসমানদের বিচার চাই। মাথা উঁচু করেই বিচার চাই, কান ধরে নয়।

শিক্ষকদের মিনমিন ভাষায় ‘ক্ষমা চাইতে হবে’ জাতীয় বিবৃতির প্রতিবাদ জানাই। মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ এটা ‘ক্ষমা’ চাওয়ার মতো অপরাধ নয়। সেলিম ওসমান ক্ষমা চাইলো কী চাইলো না, তাতে কিছু যায় আসে না। সে যা করেছে, তা অপরাধ, বড় রকমের অপরাধ। সংবিধান লঙ্ঘন করা অপরাধ। সেলিম ওসমানের শাস্তির দাবি জানাতে হবে, ক্ষমা চাওয়ার অনুরোধ নয়। কেউ কেউ বলছেন- ‘যদি তিনি অপরাধ করে থাকেন’- এ ধরনের বক্তব্য চাতুরতাপূর্ণ।

এক সময় বিটিভিতে ‘পাকিস্তানি বাহিনী’ বলা যেত না। বলা হতো হানাদার বাহিনী। এই চাতুরতাপূর্ণ বক্তব্যগুলো শুনলে সেই কথা মনে পড়ে যায়।

আজ যারা মিনমিন করছেন, নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন, কাল আপনি নিরাপদ থাকবেন- তা কিন্তু নিশ্চিত না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে, আপনাকেও কান ধরতে হতে পারে। তখন আপনিও কাউকে পাশে পাবেন না।

শুধু শিক্ষক নয়, সমাজের সব পেশাজীবীদেরই বিষয়টি মনে রাখা দরকার।

৪.
যে কোনও ঘটনার পর দাবি ওঠে তদন্তের। ‘তদন্ত’ শব্দটির আগে এখন লিখতে হয় ‘সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, প্রকৃত’ শব্দগুলো।

আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত হয় ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। যে এমপি, মন্ত্রীদের কথাকে গুরুত্বের মধ্যে ধরছে না, সেই এমপির অপকর্মের তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের। এর চেয়ে বড় কৌতুক আর কি হতে পারে!

এখানেই শেষ নয়। শিক্ষামন্ত্রী প্রচারণা চালাচ্ছেন, তিনি দুঃখ পেয়েছেন, তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কেমন তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন, কী তদন্ত করবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তদন্ত কমিটি? তদন্ত করবে, লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো কিছু বলেছিলেন কিনা। অর্থাৎ এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য না অসত্য তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। তদন্ত হবে লাঞ্ছিত-বহিষ্কৃত শিক্ষকের বিরুদ্ধে। লাঞ্ছনাকারী সেলিম ওসমান এমপির কর্তৃক কান ধরে শিক্ষককে উঠবস করানো বিষয়ক তদন্ত এই কমিটি করবে না। সেই তদন্ত করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার এই তদন্ত কমিটির নেই। কিন্তু গাল ভরা বুলি আওরানো হচ্ছে ‘তদন্ত কমিটি’গঠন করা হয়েছে।

এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেলিম ওসমান এমপিকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্যে। এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে দোষী প্রমাণ করার জন্যে। প্রমাণ করা হবে যে, তিনি ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দেওয়ার মতো কথা বলেছিলেন। কেউ এমন কথা না শুনলেও, এখন অনেক সাক্ষী বানানো হবে। কারণ নারায়ণগঞ্জ সেলিম ওসমানদের অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যে তাদের পক্ষে, তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কথা বলার মানুষ হাজির করা কোনও কঠিন কাজ নয়। প্রশাসন জানে, এখানে ওসমান পরিবারই শেষ কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে পরিবারটির দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন।

৫.
মসজিদের মাইক ব্যবহার করেই যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। মসজিদের মাইক ব্যবহার করেই সেলিম ওসমানরা গুজব ছড়িয়ে শিক্ষককে কান ধরে ‘উঠবস’ করিয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগেই জঙ্গিরা মানুষ হত্যা করে, হেফাজত তাণ্ডব চালায়। সেলিম ওসমানরাও জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে শিক্ষক লাঞ্ছনা, বহিষ্কার করে। নিজের পছন্দের লোককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

আরও পড়তে পারেন: সেলিম ওসমানের পক্ষে ৪৩ ব্যবসায়ী সংগঠন!

যে অপরাধের জন্যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কামারুজ্জামানের ১০ বছরের শাস্তি হয়, তেমন অপরাধের পরও সেলিম ওসমানরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়।

এখানে বলে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ বা যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে এই অপকর্মের তুলনা করছি না। একই প্রকৃতির একটি সুনির্দিষ্ট অপকর্মের তুলনা করছি।

রাজনীতিতে দাম্ভিকতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এক নাম্বার স্থানটি বহুকাল দখল করে রেখেছিল সাকা চৌধুরী। নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবত। একাত্তরে তো অপকর্ম করেছিলই, খুন-ধর্ষণ স্বাধীন বাংলাদেশেও অব্যাহত রেখেছিল। সেই দাম্ভিক-অশ্লীল সাকা চৌধুরীর পরিণতি, কারোরই অজানা নয়।

এখন যারা নিজেদের ‘ইনডেমনিটি’ প্রাপ্ত ভাবছেন, দাম্ভিকতায় দেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সকল অপকর্ম থেকে রক্ষা পাচ্ছেন, সব সময় পাবেন ভাবছেন, যারা ভাবতে সহায়তা করছেন- তাদের একটু ভিন্ন রকমের ভাবনাও ভেবে রাখা উচিত। ইতিহাস বড় বেশি রকমের নির্মম!

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ