X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ কি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা?

চিররঞ্জন সরকার
১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৬আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৮

চিররঞ্জন সরকার প্রায় এক মাস ধরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। সংলাপে বসেছেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি এসব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব ও পরামর্শ পেয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপি ছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে। ‘সার্চ কমিটি’র প্রস্তাবও এসেছে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে।
এই সংলাপকে দেশের সবাই ইতিবাচক ও রাজনীতিতে সুবাতাসের আভাস হিসেবেই দেখেছেন। কারণ অনেক দিন ধরে আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভয়ানক তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় বিনা ভোটে একতরফাভাবে বিজয়ী হয়েছিল। বিএনপি সেই নির্বাচন প্রতিরোধ ও বর্জনের ডাক দেয়। এরপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট প্রায় এক বছর দেশজুড়ে তীব্র সহিংস আন্দোলন পরিচালনা করে। এই সহিংসতায় অনেক নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় এক অরাজক পরিস্থিতি। বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর একপর্যায়ে বিএনপির আন্দোলন চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। সরকারি দল এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। পুলিশ দিয়ে, হামলা-মামলা করে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বিএনপিকে প্রায় বিদায় করে দেওয়া হয়।
এর পর থেকেই বিএনপি পরিণত হয়েছে ‘কাগুজে বাঘে’। বিবৃতি আর সংবাদ সম্মেলনের বাইরে দলটির কোনও তৎপরতা আর চোখে পড়ে না। তাদের কার্যক্রম ও আচরণও অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধী। অসংলগ্ন। তারা বর্তমান ‘অবৈধ’ সরকারকে মানে না কারণ তারা ‘ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে’ জয়ী হয়েছে। এই ‘অবৈধ’ সরকারের অধীনে কোনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়-বলে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের কথা বলে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা ও অনাস্থা প্রবল। বহুবার তারা নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেছে। আবার বিভিন্ন স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণও করেছে। সর্বশেষ ‘অবৈধ’ সরকার দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছে তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রস্তাবও পেশ করেছে!
যাহোক, দেশে কার্যকর ও শক্তিশালী কোনও বিরোধী দল না থাকায় সরকার এবং সরকারি দল ক্রমেই ‘দানব’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে মূলত এক দলের স্বেচ্ছাচারী শাসনের দেশে। প্রধান সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ক্রমেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বৈঠক সুধীজনের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই চান হিংসা ও সহিংসতামুক্ত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন, যারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবে। যেখানে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। আগামী নির্বাচন ঘিরে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়ুক তা কেউ-ই চায় না।
নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও সার্চ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে বর্তমানে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন দলের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অনেকে অবশ্য একে অন্তঃসারশূন্য উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন। তাদের মতে, সংসদীয় পদ্ধতির রীতি অনুযায়ী এ ধরনের বৈঠক বা আলোচনা শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র অথবা এটিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘ফটোসেশন’ মাত্র বলা যেতে পারে। কারণ, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফাইল পাঠান, রাষ্ট্রপতি সেটিই গেজেট নোটিফিকেশনের জন্য স্বাক্ষর করে পাঠান। এটা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও ভালো করে জানেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও এই কাজ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সেই সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী ইসি গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটা গাইডলাইন দিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্রপতি সেই গাইডলাইনের বাইরে কিছুই করতে পারবেন না, এটাই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার স্বাভাবিক রীতি। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের এটা অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও কেন রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে? এটা কী কৌশল? নাকি নির্বাচনি রাজনীতিতে ফিরে আসার ব্যাকুলতা?

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, আপাতত নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই যতই সংলাপ হোক, রাষ্ট্রপতির কাছে যতই দাবি উঠুক, আসন্ন নির্বাচন কমিশন হতে যাচ্ছে আগের পদ্ধতি অর্থাৎ সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমেই। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি। এই অল্প সময়ে আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে না বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলাপ-আলোচনা বা সংলাপ কী কেবলই লোক দেখানো? নাকি পরে রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে সত্যিই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে?

একথা মানতে হবে যে নির্বাচন কমিশন কোনও যে-সে প্রতিষ্ঠান নয়, এ দেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় তার ভূমিকা আক্ষরিক ভাবেই বিশিষ্ট। সেখানে যারা নিযুক্ত হবেন, তারা কেবল যোগ্য হলেই চলবে না, বহুজনসম্মত ভাবে যোগ্য হতে হবে। অর্থাৎ তিনিই যে উপযুক্ত ব্যক্তি, এই বিষয়ে যেন সাধারণমহলে কোনও প্রশ্ন বা সংশয়ের জায়গা না থাকে। তেমন সংশয় প্রতিষ্ঠানটিকে খেলো করে তুলতে পারে।

আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক বিভিন্ন পদে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার ইতিহাস খুবই সামান্য। এ ব্যাপারে কোনও নীতিমালাও নেই, কোনও কিছু ব্যাখ্যাও করা হয় না। পদে পদে স্বচ্ছতার অভাব, যুক্তি ও বক্তব্যের রাখঢাক, সব মিলিয়ে এমন ধোঁয়াটেপনাই দেশের ঐতিহ্য। গত কয়েক বছরে দেশজোড়া বিভিন্ন পদনিয়োগ প্রমাণ করেছে, ক্ষমতাসীনরা দলস্বার্থের ওপরে এক চুলও উঠতে নারাজ। অথচ শুধু প্রতিষ্ঠানের ওপরের ধাপে নয়, নিচের বিভিন্ন ধাপে ধাপে নিয়োগও একটি স্পষ্ট দল-ঊর্ধ্ব নীতির ওপর ভর করে চলাই উচিত। সেই দর্শনে আমাদের দেশের কী সামরিক, কী বেসামরিক কোনও সরকারেরই তেমন আগ্রহ বা স্পৃহা নাই। তাদের আগ্রহ কেবল বশংবদ লোকদের পুনর্বাসন, দলবাজি ও দলের স্বার্থ উদ্ধার।

আর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানটি কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, অনেক ‘সংবেদনশীল’ও বটে। নির্বাচন কমিশন সব সময়েই বিরোধীদের টার্গেট। হারলে তো কথাই নেই। লোকসমক্ষে সাফাই, নির্বাচন কমিশনের কারসাজিতে হারতে হল। পরাজয়ের লজ্জা থেকে রেহাই পাওয়ার এমন সহজ রাস্তা আর কোথায়? যেন জেতা গেম জোচ্চুরি করে হারাল রেফারি। রাজনীতিতে সত্যি-মিথ্যে এমনভাবে মিশে থাকে, আলাদা করা কঠিন। অ্যাডলফ হিটলারের সাগরেদ গোয়েবলস বলতেন, একটা মিথ্যে তিন বার বললে সত্যি হয়ে যায়। মানুষকে বোকা বানানো খুব একটা কঠিন নয়। আমাদের রাজনীতিতে এখনও সেই গেয়েবলসীয় তত্ত্বেরই প্রয়োগ চলছে। অথচ কাগজে কলমে দেশটা এখনও গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। তাকে আঘাত করে ভাঙার চেষ্টা অমার্জনীয় অপরাধ। তবু আমরা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে সব সময় একজোট হই।

পৃথিবীর খুব কম দেশেই এটা দেখা যায়। আসলে সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি হলেও তাদের মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? কারণ আমরা হেরে যাওয়ার, পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা কেবলই জিততে চাই। কিন্তু নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। একথা ঠিক যে, নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে। অনেক জায়গায় ছাপ্পা ভোট চলে। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে। সেই অনিয়ম বন্ধ করার যৌথ দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। যে দল যে এলাকায় শক্তিশালী সেখানে জুলুম চালালেই এটা হয়। সব দল যদি নিজেদের নেতা-কর্মীদের সংযত রাখতে পারে তা হলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এখানে নির্বাচন কমিশন কী করবে? ভোটে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে তাদের ভরসা করতে হয় নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর।

রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা পরিবর্তন ছাড়া আমাদের রাজনীতিতে ইতিবাচক কোনও পরিবর্তন আশা করা যায় না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যতই আলাপ-আলোচনা চলুক!

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ