X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবাল কেন টার্গেট হলেন?

আনিস আলমগীর
০৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:৪৪আপডেট : ০৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:৪৬

আনিস আলমগীর একুশের বইমেলা এলে ভীতসন্ত্রস্ত থাকি আবার কাকে হারাই। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদ চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। কয়দিন বেঁচে থাকলেও পরে মারাই গেলেন। বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২০১৫ সালে চাপাতির কোপে প্রাণ হারিয়েছেন মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎ রায়। সর্বশেষ তিন মার্চ ২০১৮ হামলার শিকার হলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ‍বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। স্থান অবশ্য বইমেলা নয়, বইমেলার পরে সিলেটে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।
পাহারাদার নিয়ে কি জীবন চলে! জাফর ইকবালেরও তো দুজন পাহারাদার ছিল। একটা সম্মেলনে ড. জাফর ইকবাল দর্শকের সারিতে বসে আছেন। রক্ষীরা পেছনে, কিছু দূরে। এর মাঝে এসে সন্ত্রাসী তার কাজ সেরে নিল। জাফর ইকবাল মরেননি। সম্মেলন স্থল না হলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। এভাবে ছোট বড় অনেকের লিস্ট করা হয়েছে। মনে হচ্ছে তারা কাউকেও রাখবে না। সব সাফ করে মেরে ফেলবে। ১৯৭১ সালে উদ্যোগ নিয়েছিলো কিন্তু সিদ্ধান্ত বিলম্বে নেওয়ায় সাফ করা সম্ভব হয়নি সবাইকে। যে অন্ধকার চিন্তা ধারণ করে ‘৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, সে অন্ধকার আমাদের এখনও ছাড়েনি।

ঘটনার পরপর অনেকের প্রশ্ন জাফর ইকবাল কেন হামলার শিকার হলেন? হয়েছেন, কারণ জাফর ইকবাল দীর্ঘদিন একক প্রত্যয় ও সাহসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যেরা লিখছেন কালেভদ্রে। তিনি মুক্তচিন্তার পক্ষে কলম ধরেই আছেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে তিনিই লিখে যাচ্ছেন। তার কথাতে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়।

হামলাকারীর বরাদ দিয়ে মিডিয়ায় এসেছে, জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বলে, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’। এই একটা বিষয় আমার মাথায় আসছে না– জাফর ইকবাল কখন ইসলামের শত্রু হলেন, কীভাবে তিনি ইসলামের শত্রু! আমি আজ পর্যন্ত ওনার একটি লেখাও পেলাম না ইসলামের বিরুদ্ধে। জামাতে ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবির বা মৌলবাদের বিরুদ্ধে, কুশিক্ষার বিরুদ্ধে কেউ যদি লিখে সেটা ইসলামের বিরোধিতা কি করে হয়!

মত প্রকাশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ওনার বক্তব্য আপনার পছন্দ না হলে তার বিরুদ্ধে কলম ধরেন। বলবেন, কোথাও আপনার লেখা ছাপায় না। তাহলে নিজের ব্লগে লিখেন, নিজের ওয়ালে লিখুন। হাজার হাজার ধর্মীয় ব্লগ আছে সেখানে লিখুন। কিন্তু কারও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে তার কল্লা নেওয়া, শুলে চড়ানোর আন্দোলন কেন! এখানেই মৌলবাদীদের সঙ্গে মুক্তচিন্তার মানুষদের পার্থক্য। মৌলবাদীরা কল্লা নিতে চায় আর আক্রান্তরা অনুরোধ করে হামলাকারীর জীবন নিও না। হামলার শিকার হয়েও জাফর ইকবাল হামলাকারীকে না মারার কথা বলেছেন হাসপাতালে নেওয়ার পথে।

অনেকদিন চাপাতি আক্রান্তের খবর ছিল না। একের পর এক জঙ্গিদের ধরার খবর ছিল। হামলাকারী ফয়জুল জঙ্গি কিনা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার না। সে মাদ্রাসায় পড়েছে। বাবাও মাদ্রাসার শিক্ষক। তবে ৫ মার্চ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে সে (হামলাকারী) সেলফ রেডিক্যালাইজড হয়ে এ হামলাটি চালিয়েছে। হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার খুব বেশি সুযোগ হয়নি। আমরা তদন্ত করছি, এই ঘটনাটির মূল উদঘাটন করবো।’ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) গিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দেখে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডাক্তারা বলেছেন, জাফর ইকবাল আশঙ্কামুক্ত।

জাফর ইকবালকে তার বিরতিহীন শুভ প্রচেষ্টার কারণেই সম্ভবত প্রথম টার্গেট করা হলো। দেশ কিন্তু উত্তপ্ত। ভেতরে ভেতরে একটা প্রচণ্ড প্রস্তুতি চলছে। যুদ্ধপরাধীদের মূল অংশের ফাঁসি হয়েছে, ১৫ আগস্ট হত্যার বিচার হয়েছে, অনেক আসামির ফাঁসি হয়েছে। জেল হত্যার বিচার হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যার বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার হত্যা প্রচেষ্টার আসামি মুফতি হান্নানদের ফাঁসি হয়েছে। এখন তারা মরিয়া হয়ে উঠবে তার প্রতিশোধ নিতে।

যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, প্রতিশোধ নিতে চায় তারা হয়তো সংঘবদ্ধভাবে কোনও জোটের সঙ্গে নির্বাচন করবে, না হয় আন্দোলনের নামে ২০১৩ সালের মতো আরও কঠোর হয়ে মাঠে নামবে। মনে রাখতে হবে, এরাই অর্থাৎ নাহাজাতুল ওলামা ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৫/৭ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিলো। এরাও হারকিউলিসের মতো ফলক পুঁতে রেখেছে- ‘ইসলামের পরে আর কোনও ধর্ম নেই’।

জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতাদের প্রায় সবারই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। একমাত্র সংগঠন হয়তো ‘চাঁদা দিতে হবে, না হয় ভাতা খেতে হবে’। কারো অজান্তে এত বড় কর্মযজ্ঞ তারা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ টেরও পাচ্ছে না। মিসরের হাসান আল বান্না প্রতিষ্ঠিত ইখওয়ানুল মুসলিমিন-এর মতো সুচারুভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ইখওয়ানুল মুসলিমিন মাঝখানে একবার মিসরের ক্ষমতায়ও এসেছিলো। মুরসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। অহেতুক তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো ইসরাইলিদের স্বার্থে।

আঠারো সমস্যার মাঝে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রশাসন খুবই কঠিন। অনেকে বলতে পারেন ইরানে তো চলছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো ইরানও আধুনিকতার সঙ্গে যতদূর সম্ভব হাত মিলিয়ে চলছে। ইরানের মজলিসে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। সম্ভবত বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ গতি প্রকৃতির জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খেলাফত ত্রিশ বছর’। ঠিক তাই ছিল। ওসমানিয়া খেলাফত তো খেলাফত নয়, তাদের হেরেমও ছিল। শাসকদের কোনও ইসলামি চরিত্র ছিল না। হজরত ওমর (রা.) ইফতার করতেন ৫/৬টা খুরমা আর এক গ্লাস জল দিয়ে। আর আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদের ইফতারির জন্য ব্যয় হতো ১২ হাজার দেরহাম।

হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক কিংবা কওমি মাওলানাদের সনদের স্বীকৃতি, সরকারি চাকরি প্রাপ্তি অনেকের সমালোচনার বস্তু। কিন্তু একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে কীভাবে রাষ্ট্র চলবে তার কথা কেউ বলছি না। তাদের মূল স্রোতে আনার যেমন দরকার আছে তেমনি অন্যকে নির্মূল করে দেওয়ার তাদের রেডিক্যাল চিন্তা পরিহারেরও দরকার আছে।

বর্তমান তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র ধর্মের উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তারা কী বলতে চায় লোকে শুনুক। আমি তো দেখি মানুষ ধর্মকর্ম করে থাকেন কিন্তু মাওলানাদের ভোট দেন না। সন্ত্রাস গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও কোনও বিধিসম্মত ব্যবস্থা নয়, আবার ধর্মতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও নয়। তারা তাদের কথা মানুষের কাছে না বলে সন্ত্রাস করলে তো মানুষ মেনে নেবে না। বাংলাদেশের মানুষ চরম ইসলামপন্থীও নন আবার ধর্মহীনতায়ও বিশ্বাস করেন না।

আমি একবার দিল্লি সফরে গিয়ে তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব আমির মরহুম সৈয়দ এনামুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে খুব সমাদর করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার জানার কিছু আছে কিনা? তখন তাকে বলেছিলাম, তুরাগের তীরে আপনি দাঁড়িয়ে ডাক দিলে তো ইসলাম কায়েম হয়ে যায়। সে ডাক আপনি দেন না কেন? তিনি বলেছিলেন, ইসলাম কায়েম করার মতো সমাজে অবস্থা বিরাজমান নয়। অনুরূপ অবস্থায় সমাজে ইসলাম কায়েম করলে শরীয়া অনুসারে হাত পা কাটতে কাটতে সম্পূর্ণ জাতিই পঙ্গু হয়ে যাবে। আল্লাহ তো একটা জাতিকে পঙ্গু করার জন্য ইসলাম পাঠায়নি। সুতরাং আগে তবলিগ করে মানুষকে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। তারপর ইসলাম।

কথাটা আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছিলো। অবশ্য এক আলেম আরেক আলেমের কথা মানেন না। এটা আলেমদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য পাকিস্তান সরকার বিচারপতি মুনিরকে দিয়ে কমিশন গঠন করেছিলেন। বিচারপতি মুনির নাকি ১০০ আলেমকে লিখিতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন–ইসলাম কী? ১০০ জনই উত্তর দিয়েছিলেন, তবে কারও সঙ্গে কারও মিল ছিল না। বিচারপতি মুনির তার এ কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।

জাফর ইকবালকে চাপাতি দিয়ে লোক সমাবেশে মারতে এসেছে। এতে বুঝে নিতে হবে তারা তাদের প্রস্তুতির শেষলগ্নে। এখন অসম্প্রদায়িক লোকদের বৈঠক ডেকে একটা দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করা প্রয়োজন, যেন সন্ত্রাস না ছড়ায়। যেন মানুষে মানুষে যুদ্ধ না হয়। ধর্মে ধর্মে যেন সম্প্রীতি বিরাজ করে। মৌলবাদীরা শুধু ইসলাম ধর্মে স্থান নিয়েছে ভাবা ঠিক নয়, সব ধর্মে আছে। ইউরোপের লোকেরা ৩০ বছর যুদ্ধ করেছিলো ধর্ম নিয়ে। ইউরোপ যখন উদ্ভাবনে মনোযোগী হলো তখন এর অবসান হয়েছিলো। অসম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংঘবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে দেশময় আন্দোলন গড়ে না তুললে তো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সম্মিলিত চেষ্টা করলে আমরাও পারবো মৌলবাদকে পরাস্ত করতে।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের
মেলায় এসেছেন চিত্রনায়িকা, দেখতে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ী নিহত
মেলায় এসেছেন চিত্রনায়িকা, দেখতে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ী নিহত
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে বন্ধ থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ