তিনি অন্য সবার থেকে একটু আলাদা। তার জীবন সংগ্রাম যে কার চেয়ে একটু বেশিই কঠিন। বই প্রকাশের দায়ে ধর্মান্ধদের হাতে খুন হয়েছেন স্বামী। পিতৃহারা সন্তানদের কাছে হয়ে উঠেছেন বাবা- মা দুজনই। সামলাচ্ছেন সংসার, নিজের চিকিৎসা পেশা, স্বামীর চেতনা বাঁচিয়ে রাখতে হাল ধরেছেন প্রকাশনী সংস্থার। হয়েছেন বইয়ের ফেরিওয়ালা। দশভূজা রূপে সামালাচ্ছেন সবকিছু। তিনি সময়ের সবচেয়ে আলোচিত নারী প্রকাশক ও উদ্যোক্তা ডা. রাজিয়া রহমান জলি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রকাশনা খাতে নারীরা অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশে নারী প্রকাশক নেই বললেই চলে। ২০১৫ সালে উগ্রবাদীদের হাতে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন নিহত হওয়ার পর স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন তার সহধর্মিণী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। জলি দায়িত্ব নেন জাগৃতি প্রকাশনী পরিচালনার।
জানালেন, বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতে শুরু থেকেই পুরুষের আধিপত্য। তবে নারীদের জন্যও এটি অনেক সম্ভাবনাময় একটি খাত। নারীরা এখন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় ঝুঁকছেন। নারীরা পার্লার, বুটিক, গার্মেন্টস, ট্যানারি ব্যবস্যা করছেন। সেক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদেরকে প্রকশনার দিকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। নারী হিসেবে প্রকশনা খাতে অতিরিক্ত কোন বিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিয়া রহমান জলি বলেন, নারী মানেই প্রতিকূলতা বিজয়ী। নারী সন্তান ধারণ করে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বিজয়ী হয়। তাই নারীর জন্য যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জয়ী হওয়া খুব সহজ বলে মনে করেন তিনি।
রাজিয়া রহমান জলি প্রতিষ্ঠা করেছেন বুক শপ ও ক্যাফে দীপনপুর। সেখানে বসে যখন কথা হয় তখন সদ্য সমাপ্ত বইমেলার হিসাব নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত তিনি। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলায় ভীষণ মর্মাহতও। একই ধরনের হামলায় প্রিয়জন হারানো জলি জানালেন, এই ধরনের হামলা বন্ধের জন্যই তার দীপনপুর প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিশুদের বইমুখী করতে তার এই প্রচেষ্টা। শিশুদেরকে বইমুখী করার জন্য সব বাবা মায়ের প্রতি অনুরোধ তার। শুধু ঢাকা শহর নয়, সারাদেশের পাড়া মহল্লায় তিনি দীপনপুর, বাতিঘর কিংবা বেঙ্গল বইয়ের মত বুক শপ ও ক্যাফে গড়ে তোলার আহবান জানান। তাতে করে বই পড়ার চর্চার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের আয়ের ব্যবস্থা কিংবা পরিচালনা ব্যয় উঠে আসবে বলে অভিমত দেন তিনি।
রাজিয়া রহমান জলির প্রতিষ্ঠিত দীপনপুরে প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে বই। রয়েছে ফয়সল আরেফিন দীপনের কিছু স্মৃতি স্মারক। দীপনপুরে রয়েছে দীপাঞ্জলি নামে ক্যাফে। বই কেনার পাশাপাশি চা বা কফির সঙ্গেও পড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। এখানে বসে বই পড়তে কোনও খরচ নেই। নিজে চিকিৎসক তাই ক্যাফের খাবারের মানে নিয়েছেন বিশেষ সতর্কতা। বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস, চা, কফি, ফ্রেশ জুস নিয়ই তার ক্যাফে।
ছোটদের বই নিয়ে রয়েছে আলাদা কর্নার, যার নাম দীপান্তর। এখানে শিশুদের বই পড়ার পাশাপাশি রয়েছে খেলাধুলারও ব্যবস্থা। এছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার দীপনপুরে রয়েছে শিশুদের ছবি আঁকার ক্লাশ। জ্যৈষ্ঠ নাগরিকদের বই পড়ার জন্য দীপনপুরে রয়েছে সিটিজেন কর্নার। রয়েছে নামাজের স্থান। আর রয়েছে দীপনতলা নামে একটি মঞ্চ। যেখানে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন লেগেই আছে। দীপনপুরের পাঠক ক্রেতারা উপভোগ করতে পারছেন সেসব অনুষ্ঠান। এছাড়া রয়েছে অনলাইনে বই কেনার ব্যবস্থা। বইয়ের পাশাপাশি স্টেশনারি এবং শিল্পীর আঁকা ক্যানভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
প্রকাশনা সংস্থা, বুকশপ, চিকিৎসা পেশা, সংসার এতকিছু কিভাবে সামলান জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময়কে ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি আরও জানান, তিনি একলা কাজ করছেন না, তার সঙ্গে আছেন সহকর্মী ও বন্ধুরা। মোট ১১ জন কাজ করছেন দীপনপুর ও জাগৃতি মিলে।
তাই একটু কষ্ট হলেও ক্লান্ত হন না। যতদিন সময় পাবেন সত্য ও সুন্দরের জন্য, মানুষের জ্ঞানের জন্য বইয়ের ফেরি করে যাবেন বলে জানালেন অকুতোভয় রাজিয়া রহমান জলি।