X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় দশ

অংশুমান কর
১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

মেঘদূত

একে বিরহ বলব না?
এই যে তুমি মাইল মাইল দূরে চলে গেছ
এই যে তোমার হালকা ওডিকোলনের গন্ধ
            সমুদ্রের ওই পারে বিশ্রাম নিচ্ছে—
                                                 একে?
তবে শোনো : শান্ত মেঘের মতো এক স্বর
                                       তার ডালপালা
    আমাকে ছাপিয়ে রেখেছে
আমি ক্রিকেট বলের মতো
    এই ব্যাট থেকে ওই ব্যাট
    এই হাত থেকে ওই হাত
উড়ে উড়ে সেলাই ফাটিয়ে ফেলেছি
    আমার ত্বক, তার নীল হয়ে আসা শিরা
    ছিঁড়ে ছিঁড়ে তোমার নাম ছিটকে উঠেছে বারান্দাময়
দেখো : রোদ্দুর কীরকম স্নান হয়ে গেছে
আর তুণ গুছিয়ে অর্জুনও ফিরে আসছেন ঘরে...
    ...ভাসতে থাকা অল্প মেঘ, লক্ষ্মী সোনা আমার, বলো
                একে বিরহ বলব না, একেও?


কণিষ্ক

ঘোড়াদের চিৎকার আর আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি না সোজাভাবে। হাত তুলে
দেখলাম—না, ঠিক আছে; এখনও কাঁধের ওপর মুণ্ডু, যেমন থাকা উচিত। হাত আর
পায়ের ভেতর শিরশির করে ঢুকে যাচ্ছে ত্রিপিটকের সূত্রগুলো। তাহলে কেন আমি
যাতে কিছুতেই মাটি না পায় ওরা সেই চেষ্টা করেছি এতদিন? মহামান্য সম্রাটের মতো
দাপিয়ে বেড়ানো যেত এই পৃথিবীর ওপর, কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা এই সেদিন
পর্যন্ত দেখিনি। আমি কোনোভাবেই অপরাধী নই। আমি নিজের শার্ট প্যান্ট আর
অঙ্কখাতার ময়লা যাতে দূর হয় সেই চেষ্টা করেছি মাত্র তাহলে স্থির গাছের
মতো দাঁড়িয়ে থাকা লাল পাথর বলো কেন আমার মাথা নেই মাথা নেই মনে হচ্ছে বারবার


আজ মঙ্গলবার

পৃথিবীতে ফুটে রয়েছে ঘাসফুল
বর্ষাও এসেছে কিছু আগে
সমুদ্রকে পোষ মানিয়েছে লোকেরা
এখন আর পেছনে তাকাবে কেন?
উঁচু টিলার ওপর ঘুরে ঘুরে নাচ হচ্ছে, উৎসব
চলো, বেরোই ভাইসব, বাঁধো আমাদের ঢাল
                    নাও আমাদের তির, ঝকঝক করুক বর্শা
ঈশ্বরের প্ল্যান একটু ওলটপালট করা যাক
পৃথিবীতে ফুটে রয়েছে ঘাসফুল
ফুলের সঙ্গে তো বিরোধ নেই, কী নাইস বর্ষা!
আমরা মহাকাশকে নতুন করে সাজাতে চাই শুধু
চলো চলো ভাইসব, আজ মঙ্গলবার,
পাড়ার জঙ্গল সাফ করার দিন
ঈশ্বর রাগ করেন করুন
নদীর গতি পালটাই, নক্ষত্রকে বলি:
                     ঠিক হচ্ছে না কিন্তু
ইঞ্চি মেপে, কালার বেছে
ড্রয়িংরুমের মতো মহাকাশকেও উলটে পালটে নিই একটু


সন্ধে
লম্বা থুতনি মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সন্ধে হল
দূরে, অন্য একটা জীবনের ভেতর ভদকা খুলল কেউ
যে-জীবন আমাদের নয় তার ভেতর শুয়ে থাকবার ভান করল
আমরা দেখলাম সন্ধে নামল
বরফের মতো সন্ধে ঝুপঝাপ নেমে আসতে লাগল
সাদা হয়ে গেল মেয়েদের থুতনি, চেয়ে থাকা
যে-জীবন আমাদের নয়, তার দিকেই তো যেতে চাই
                                            জলের, রহস্যের জীবন
প্রতিদিন ঘণ্টা শুনে শুনে
প্রতিদিন ক্যাট ব্যাট ম্যাট পড়ে ও পড়িয়ে
আমরাই টা টা করছি জীবনকে
নাও, আমাদের ব্যর্থ দিন শালপাতায় মুড়ে
                                            তোমাকে দিলাম
নাও, আমাদের ব্যর্থ রাত উপুড় করলাম তোমার ফার্নেসে
এবার পোড়ার জন্য অপেক্ষা
ছাই ও শূন্যতার জন্য     দাঁড়িয়ে থাকা
সন্ধে হল। লম্বা থুতনির মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
                                                                 আরও একটা সন্ধে


আউটিং

কতদিন পর আজ প্রকৃতির জন্য দু-চার লাইন
দেখেছ দেখেছ একে বলে শালগাছ
শিরীষ গাছ চেনো না?
হ্যাঁ বসন্তই তো পলাশ ফোটার সময়
কতদিন পর আর ঈর্ষা না লোভ না ছুরি চালাচালি না
শুধু গাছ
প্রকৃতির জন্য দু-চার লাইন
আমি যে প্রকৃতি চিনি না কাকু—আমার কী হবে?
ছোটোবেলা থেকে শুরু করতে হবে আবার, গোড়া থেকে
রেললাইন ধরে চলে গেলে একদিন বাসরাস্তা ধরে চলে গেলে
তোমার পাঠ সম্পূর্ণ হবে
ফেরার পথে তুমি বিদ্যাসাগর আঙুল গুনে গুনে বলবে
ওই শিরীষ এই বাবলা এই অশ্বখ
মানুষ ছাড়া আর একজনই পৃথিবীর ওপর
                                      শক্ত দাঁড়ায়
সে গাছ
নাও আজ বিয়ার খুলো না
মাইলস্টোন গোনো
এক-এ শিরীষ, দুই-এ বাবলা, তিন-এ অশ্বত্থ
আহ্! কতদিন পর আবার আবার
ভ্রমণ কাহিনির প্রথম পৃষ্ঠা, প্রকৃতির জন্য দু-চার লাইন!


মাইন

শুধুমাত্র বেঁচে থেকেই কেউ কেউ আমাদের কষ্ট দেয়। কোনো ক্ষতি করে না আমাদের,
ভয় দেখায় না, চাক্কু দেখায় না, ভিড়ের ট্রেনে ছিঁড়ে নেয় না বউ-এর লকেট। শুধু বেঁচে
থাকে। বছরের পর বছর, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, মানুষের উপেক্ষা, ছোড়া ঢিল, গরম জল
হজম করে বেঁচে থাকে। আমরা ভাবি, লোকটা মরলেও তো পারে, কাল থেকে যেন
আর না দেখতে হয় ওর মুখ। কিন্তু পরের দিনও আমরা দেখি মোড়ের মাথায়,
শিবমন্দিরের পাশে, প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে ঠিক বেঁচে আছে। আমাদের যাওয়া ও আসার
পথে ঘুমন্ত মাইনের মতো বেঁচে থেকে অস্বস্তি ছড়াচ্ছে।


কাজের লোক

কোন চারাগাছটার কতটুকু জল দরকার
আপনি না জানলেও ও জানত
গাছকোমরে শাড়ি পরা মেয়ে
ভালো করে সূর্য ওঠার আগেই যার উঠোন ঝাঁটানোর শব্দে
জেগে উঠত পাড়া
তিন-চারটে ভুলি কুকুর ঘুরে বেড়াত পায়ে পায়ে
পাওনা দুটো বিস্কুটের একটা
সমান করে ওদের মধ্যে বেঁটে দিত ও।
ওরই কোলে পিঠে চড়ে কখন যেন বড়ো হয়ে গেল শচীশ
আপনি খেয়ালই করেননি।
খেয়াল যখন করলেন তখন
শচীশের ফ্ল্যাটে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হাতে ঘুরে বেড়ায় অন্যজন
শচীশের ছেলে তাকে ডাকে 'পি পি'
জানে সে আসলে তাদের 'মেড' যে
একদিন না এলেই মা তুলকালাম করে।
মাঝে মাঝে যখন সেও চালিয়ে দেয় এফ এম
আপনার মনে পড়ে
কতদিন আপনার শোনা হয়নি অনুরোধের আসর
হালকা লেবু তেলের গন্ধ কতদিন ভেসে বেড়ায়নি ঘরে
কতদিন উঠোন ঝাঁটানোর শব্দে আর
                                  ঘুম ভাঙে না আপনাদের।


বন্ধু

পুরোনো জামাকাপড়কে শরীর দেয়
কাজের লোকের ছেলেমেয়ে।
ঝরা ফুলের জন্য বুক পেতে দেয় পথ।
উন্মাদের জন্য সরকার বানিয়েছে হাসপাতাল।
অতিথিকে জায়গা দেয় ফটোগ্রাফ।
আহত মানুষ 
ভেবো না যদি কেউ তোমাকে না নেয়
ওই তো তোমাকে ডাকছে
ছোটো ছোটো চায়ের দোকান আর
নিভু নিভু লণ্ঠন


স্তাবক

প্রতিদিন চুপ করছে, কারও কথা থেমে যাচ্ছে রোজ
জঙ্গলে, নদীর পাড়ে, বস্তিতে, শহরে
মাথা কেটে পড়ে থাকছে, পড়ে থাকছে গুলি বুকে নিয়ে,
তাঁর কথা শিরোধার্য, মুখ খোলা একযুগ বারণ
তাই শুয়ে থাকছে স্থির, শুয়ে থাকছে হাসিমুখ লাশ
দেখে সূর্য অন্ধকার, দেখে পাখি ডালে ডালে চুপ
তবু গান গাইছে গুণী, শিল্পী বলছে, 'চমৎকার রৌদ্র
একটা দুটো মরছে ঠিক, একসঙ্গে মরেনি চোদ্দ!' 


দূরত্ব

আমি কলকাতা শহরে আর তুমি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। বঙ্গদেশে।
রোজ দেখা হয় না। কথা হয়। চড়াই পাখি মারতে মারতে এক মোবাইল থেকে আর-
এক মোবাইলে ছুটে যায় তরঙ্গ, আমাদের ভালোবাসা। দেখা হয় না, কথা হয়। তবু
মনে হয় যেন ছুঁয়ে আছি। মনে হয় পাশে বসে আছ। লিখি না 'মিসিং ইউ'। কিন্তু যখন
কলকাতা শহর ছেড়ে, বঙ্গদেশ ছেড়ে, প্লেন আমাকে নামিয়ে দেয় অন্য ভারতবর্ষে,
লিখি 'মিসিং ইউ', লিখি 'মন খারাপ'। মনে হয় কত দূরেই না রয়েছি, এসেছি বিদেশে।
যদিও, দেশে ফিরলেও, জানি, এখনকার মতোই, শুধু কথাই হবে, দেখা হবে না।

হায়, আমার এখনও চল্লিশ হয়নি, এখনই কেন আমি জেনে গেলাম এই নির্মম সত্য?
বলো, স্লেটে কে লিখে রেখেছে : দূরত্ব মানসিক?




অংশুমান কর বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি পূর্ব অঞ্চল, সাহিত্য একাডেমির সচিব এবং সাহিত্য একাডেমির উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। প্রথম কবিতার বই : ‘খেলনা পিস্তল’। কবিতা ও প্রবন্ধের বই বিশের অধিক। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুরস্কর-সহ দেশ বিদেশের নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
প্রিয় দশ
দোআঁশে স্বভাব জানি
প্রিয় দশ
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে নাব্য সংকট, ৫ উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু