X
শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
১৩ আষাঢ় ১৪৩২

বুড়িগঙ্গা: এক দুঃখিনীর উপাখ্যান

ইউশা রহমান
০৭ মে ২০২০, ১৯:০০আপডেট : ০৭ মে ২০২০, ১৯:২৫

বুড়িগঙ্গার ছবিটি ১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা দ্য রোম্যান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। বইটিতে ঢাকা শহরের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাওয়া যায় রায়সাহেব বাজারে জায়গির থাকতেন তিনি। তখন প্রায় দিনই সূর্যোদয়ের আগে গামছা কাঁধে পা বাড়াতেন সদরঘাটে। সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যেতেন মাঝ নদীতে। তখন বর্ষার বুড়িগঙ্গা ছিল দেখার মতো।

নদীর এপারে ছিল সারি সারি বজরা নৌকা। ওপারে সবুজ গ্রাম। কিছুটা পশ্চিমে ছিল জিঞ্জিরার বাজার। সিম্পসন রোডের পশ্চিম কিনারে দেখা যেতো মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়ি এবং ইডেন হাইস্কুলের ছাত্রীদের দোতলা হোস্টেল।

সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধে এবং এর নিচে নদীতে ভাসমান বজরা নৌকার বহর ছিল তৎকালীন ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকর্ষণ। ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পুরনো দিনের বুড়িগঙ্গার এমন বর্ণনা দিয়েছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন।

বুড়িগঙ্গায় গোসল করার এমন বর্ণনা পাওয়া যায় আবুল ফজলের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রেখাচিত্রে’ও। বুড়িগঙ্গার অদূরে এক মেসে থাকতেন তিনি। খুব ভোরে উঠে দলবেঁধে সেখানে গোসল করতে ও সাঁতার কাটতে যেতেন। একটি সাঁতার সংঘও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা কানায় কানায় ভরে উঠতো তখন কী আনন্দেই না আমরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর এপার-ওপার সাঁতরাবার প্রতিযোগিতায় নামতাম।’ চাঁদনী রাতে সবাই মিলে চলে যেতেন বাকল্যান্ড বাঁধ তথা বুড়িগঙ্গার তীরে। নদীর মনোরম পরিবেশে হেলানো বেঞ্চে বসে রাতের পর রাত আড্ডা দিয়ে কেটে যেতো। মুখে মুখে বানাতেন ছড়া।

বুড়িগঙ্গা একসময় ছিল কখনও ভারী বর্ষণ শেষে প্রমত্তা নদী, আবার কখনও ছিল নিঃশব্দে বয়ে চলা শান্ত নদী। রাতের আঁধারে নিঃসঙ্গ নৌকার বুকে টিমিটিম করে জ্বলতো বাতি। নৌকায় আহার করতেন দূর থেকে আসা মাঝি-মাল্লারা। ‘ঢাকা পুরাণ’ গ্রন্থে মীজানুর রহমান ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘দূর-দুরান্ত থেকে মাল্লাই দোমাল্লাই নৌকা এসে ভিড়তো নারিন্দার পুলের আশেপাশে। এসব নৌকায় বেদেরা নিয়ে আসতো মাটির হাঁড়ি, কলসি ও অন্যান্য তৈজসপত্র থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। তখন ঘাটজুড়ে চোখে পড়তো বেদেদের নৌকার বহর।’
ঢাকার অনেক সুখ-দুঃখের গল্প ও উপকথা বুড়িগঙ্গার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একইসঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজ-রাজাদের কাহিনি, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটক ও বণিকদের বিচরণের গল্পও আছে। সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে বুড়িগঙ্গাকেন্দ্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের চিত্র। এ পালাবদলে বুড়িগঙ্গার রঙ, বেশভূষা বা আচার-আচরণ অনেকটা পরিবর্তন হলেও আজও অবিরাম চোখে ভাসে অতীতের দৃশ্যপট। কবি শামসুর রাহমান জানিয়েছিলেন, পুরনো ঢাকায় তিনি পুরনো ইতিহাসের নিশ্বাস ও দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান। দেখতে পান না-দেখা অনেক ঘটনার ছায়ার মিছিল।

বাস্তবিকভাবেই, বুড়িগঙ্গার কূল যেন ছাপিয়ে উঠেছে ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের ঘোরগ্রস্ত করে। এখানে বিচরণকারীদের পদচিহ্ন শহরের পদে পদে পড়ে আছে। অদেখা মোগল বা ব্রিটিশ শাসকদের আনাগোনা, নবাবদের রাজকীয় দরবার, সৈন্যদের কুচকাওয়াজ এসব আজও যেন চোখে ভাসে। ১৯২৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন বুড়িগঙ্গার বুকেই ‘তুরাগ’ নামক হাউজ বোটে রাতযাপন করেন তিনি।

১৯২০-এর দশকে বুড়িগঙ্গার তীরে নর্থব্রুক হল। ছবিটি ঢাকা কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে নর্থব্রুক হল, রূপলাল হাউজ, আহসান মঞ্জিল ও লালবাগ কেল্লা ইত্যাদি তো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। লালবাগ কেল্লা এখন নদী থেকে খানিকটা দূরে মনে হলেও আগে নদী ঘেষেই ছিল। ১৮৪০ সালে সরকারি আদেশে প্রকাশিত ‘অ্যা স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স অব ঢাকা’ গ্রন্থে জেমস টেলর লিখেছেন, ‘শুরুর দিকে লালবাগ কেল্লা বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন ছিল। এখন তা সরে গেছে অনেকটা।’ বইটি যখন লেখা হয় তখনই নদী ও লালবাগ কেল্লার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। লেখক ঢাকা শহরকে ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করেছেন এই গ্রন্থে।

সিপাহী বিদ্রোহের মুক্তিকামী সিপাহীদের আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বুড়িগঙ্গার পার্শ্ববর্তী আন্টাগড়ের ময়দান (বর্তমানে বাহদুর শাহ্ পার্ক)। বিদ্রোহে অংশ নেওয়া মুক্তিকামী সিপাহীদের এখানেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। বুড়িগঙ্গার অদূরে পাটুয়াটুলিতে অবস্থিত ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির। জীবনানন্দ দাশের বিয়ে হয়েছিল এই মন্দিরে। এলাকাটিতে বিচরণ করেছেন একসময়ের শেলি ও কিটস আওড়ানো ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র ও কবি বুদ্ধদেব বসু; যিনি নিজেও ঢাকার স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর লেখায়। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু উভয়ে ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের অন্তর্ভুক্ত।

বুড়িগঙ্গা ভালো নেই হৃদয়নাথ নামের একজন আইনজীবীর কথা আছে মুনতাসীর মামুনের লেখায়। মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী হৃদয়নাথ ১৮৬৪ সালে মাত্র আট বছর বয়সে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন সিপাহী বিদ্রোহের রেশ কাটেনি। বিশ শতক পর্যন্ত তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। পরিণত বয়সে লিখেছিলেন ‘রেমিনিসেন্সেস অব ঢাকা’ বা ‘ঢাকার স্মৃতি’ নামের ১১ খণ্ডের একটি গ্রন্থ। হৃদয়নাথ তার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতেন লোহারপুলে। তখন তাদের কাছে শহরের আশ্চর্যজনক বিষয়গুলোর একটি ছিল এটি। লোহারপুলের ওপর দিয়ে দোলাই খাল পার হওয়া ছিল রোমাঞ্চকর ব্যাপার।

ধোলাইখালের ওপর নির্মিত পুল নিয়ে বিভিন্ন লেখায় অনেক কথা পাওয়া যায়। যেমন বলা যায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা। কোনও এক দুর্যোগের রাতে লোহারপুল একা পাড়ি দিচ্ছিলেন তিনি। তখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মেঘের গর্জনও ছিল। তখন তিনি খেয়াল করলেন উল্টো দিক থেকে এক পুরুষ ও এক নারী পুল অতিক্রম করছে। দুর্যোগপূর্ণ রাতে জনহীন পথে একসঙ্গে নর-নারীকে দেখা ছিল তার জন্য রহস্যময়। সেই অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন তাঁর অন্যতম সেরা গল্প ‘হয়তো’। ধোলাইখালের ওপর নির্মিত পুলটি এখন নেই।

বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা। বুড়িগঙ্গা ঢাকার জন্মদাত্রী মা। এখন অবয়বের বদল হয়ে বুড়িগঙ্গা যেন সিংহাসন হারানো কোনও নারী। কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। ঢেউয়ের রঙ পরিবর্তন হয়ে কালো বা অন্য রাসায়নিকের রঙ ধারণ করেছে অনেক জায়গায়। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যায় বর্জ্য। বুড়িগঙ্গার দিকে এখন তাকালে দু’চোখ জলে ছলছল করে। জীবনানন্দ দাসের কবিতায় আছে, ‘মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা।’

যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট অসহায় বুড়িগঙ্গা। ছবিটি তুলেছেন ওয়াহিদা জামান সিঁথি বুড়িগঙ্গার সঙ্গে ঢাকার মানুষের নিবিড় সম্পর্ক এখন নেই। মানুষ সুপেয় পানির প্রয়োজনে বুড়িগঙ্গায় যায় না। নগরজীবনে প্রয়োজন হয় না বুড়িগঙ্গায় গিয়ে গোসল করার। চাইলেও যে এখন স্বচ্ছ ও সুপেয় পানি পাওয়া সম্ভব নয়। একসময়ের প্রকৃতির আদরে মোড়া বুড়িগঙ্গা আজ যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট।
বুড়িগঙ্গার দুঃখ আমাদের দুঃখ। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংঘর্ষ চলছে প্রতিনিয়তই। মাতৃরূপী বুড়িগঙ্গা এ সংঘর্ষে যেন স্বভাবসুলভ কোমলতায় পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। এতে আগের মতো খেলা করে না রূপালি ঢেউ। খালি চোখে এতটুকুই দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা আর্তনাদ করছে, বুড়িগঙ্গা ভালো নেই।

পুনশ্চ: লেখাটি তৈরিতে আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আত্মস্মৃতি’, আবুল ফজলের ‘রেখাচিত্র’, মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা সমগ্র ও ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’, মীজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’, নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, শামসুর রহমানের ‘আমার ঢাকা’, ফ্রান্সিস ব্রাডলির ‘ঢাকা দ্য রোম্যান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’, জেমস টেলরের ‘অ্যা স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স অব ঢাকা’ এবং এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘ঢাকা কোষ’ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বইগুলোর লেখক, সংকলক ও প্রকাশকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: নদী গবেষক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কাঁঠালের বিচি দিয়ে লইট্টা শুঁটকি ভুনার সহজ রেসিপি জেনে নিন
কাঁঠালের বিচি দিয়ে লইট্টা শুঁটকি ভুনার সহজ রেসিপি জেনে নিন
সামাজিক ব্যবসা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে: প্রধান উপদেষ্টা
সামাজিক ব্যবসা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে: প্রধান উপদেষ্টা
খুলনায় এক রাতে দুই খুন
খুলনায় এক রাতে দুই খুন
পাঁচ দাবিতে এনটিআরসিএর সামনে মহাসমাবেশের ঘোষণা
পাঁচ দাবিতে এনটিআরসিএর সামনে মহাসমাবেশের ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
পরীক্ষায় বাড়তি সময় না দেওয়ায় পরিদর্শককে মারধর ছাত্রদল নেতার, দিলেন হত্যার হুমকি
পরীক্ষায় বাড়তি সময় না দেওয়ায় পরিদর্শককে মারধর ছাত্রদল নেতার, দিলেন হত্যার হুমকি
মাসদার হোসেন মামলার রিভিউ আবেদনের রায় রবিবার
মাসদার হোসেন মামলার রিভিউ আবেদনের রায় রবিবার
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা নিয়ে ক্ষোভ হাসনাত-সারজিসের
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা নিয়ে ক্ষোভ হাসনাত-সারজিসের
মব না, এটি প্রেসার গ্রুপ: প্রেস সচিব
মব না, এটি প্রেসার গ্রুপ: প্রেস সচিব
জাতীয়করণ নয়, এমপিওভুক্তির আওতায় আসছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা
জাতীয়করণ নয়, এমপিওভুক্তির আওতায় আসছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা