আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের শুরুতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো এমপিওভুক্ত ও পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আপাতত এসব মাদ্রাসা সরকারি হচ্ছে না। যদিও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হিসেবে বেতন-ভাতা পাবেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এমপিও নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা) মো. সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমপিও নীতিমালা করা হয়েছে। ইবতেদায়ির শিক্ষকরা বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মতোই সুযোগ-সুবিধাসহ বেতন-ভাতার সরকারি অংশ পাবেন।’
জানা গেছে, বুধবার (২৫ জুন) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন, পাঠদান, স্বীকৃতি, পরিচালনা ও জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জনবল কাঠামো ও বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নীতিমালা করেছিল কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। যদিও সেই নীতিমালা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাননি শিক্ষকরা। তবে নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষকরা সরকারি বেতনের অংশ পাবেন।
বর্তমানে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধানরা মাসিক সাড়ে ৩ হাজার টাকা ও সহকারী শিক্ষকরা মাসিক ৩ হাজার ৩০০ টাকা অনুদান পান। শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে গত ২৮ জানুয়ারি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৫ মার্চ সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের শেষ কর্মদিবসে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী (ইআইআইএন) ১ হাজার ৫১৯টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদন দেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে মোট ১৮ হাজার ১৮৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার নিবন্ধন দেয় সরকার। একইসময়ে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়কেও নিবন্ধন দেওয়া হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতোই ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসাকে ৫০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া শুরু হয়। একই সময় সমান অনুদান পাওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি করা হয়েছে। আর সেই ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসাকে এখনও সামান্য অনুদানই দেওয়া হচ্ছে।
বিগত সরকার ২৬ হাজার ১৫৯টি নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করে। আর প্রাথমিক সমমানের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা বেতন কাঠামোর আওতায় আসেনি। তাদের দেওয়া হয় সামান্য অনুদান।
এমপিও নীতিমালা
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন, পাঠদান, স্বীকৃতি, পরিচালনা ও জনবল কাঠামো মেনে এমপিওভুক্ত করবে সরকার। নীতিমালা অনুযায়ী, নতুন করে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপনেরও সুযোগ রয়েছে।
শর্ত শিথিল
শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি এলাকা, হাওর এলাকা, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বস্তি এলাকা, নারী শিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, পাঠদান, অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি ও এমপিও দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করবে সরকার।
ম্যানেজিং কমিটি
ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিকে উপজেলা পর্যায়ে অনুমোদন দেবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক।
ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সচিব পদাধিকারবলে মাদ্রাসা প্রধান। এছাড়া শিক্ষক প্রতিনিধি একজন, শিক্ষার্থীর অভিভাবক প্রতিনিধি একজন, উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা একজন, দাতা সদস্য একজন, উপজেলা পর্যায়ে হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনোনীত একজন, আর সিটি করপোরেশন বা শহরে হলে জেলা প্রশাসক মনোনীত একজন সরকারি কর্মচারী সদস্য হিসেবে থাকবেন। উপজেলা হলে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মনোনীত এবং জেলা শহরে হলে জেলা শিক্ষা অফিসারের মনোনীত একজন সদস্য থাকবেন ম্যানিজিং কমিটিতে।
ম্যানিজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন শিক্ষকদের ভোটে এবং অভিভাবক সদস্য নির্বাচিত হবেন অভিভাবকদের ভোটের মাধ্যমে। ম্যানেজিং কমিটি গঠনের পর প্রথম সভায় প্রধান শিক্ষক এবং শিক্ষক প্রতিনিধি ছাড়া অন্য সদস্যদের মধ্য থেকে সভাপতি নির্বাচিত হবেন। কমিটির মেয়াদ হবে প্রথম সভা থেকে তিন বছর। ম্যানেজিং কমিটি বেসরকারি স্কুল-কলেজের মতোই কাজ করবে।
জনবল কাঠামো
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জনবল কাঠোমোতে বলা হয়—প্রধান শিক্ষক একজন, সহকারী শিক্ষক সাধারণ একজন, সহকারী শিক্ষক বিজ্ঞান একজন, সহকারী শিক্ষক আরবি একজন, সহকারী শিক্ষক ক্বারী একজন এবং একজন অফিস সহকারী থাকবেন।
এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া
অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির পর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের নামে নামজারি করা জমি, নিজস্ব ভূমিতে অবকাঠামো, হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমাণপত্র, অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির প্রমাণপত্র ও অন্যান্য শর্তসাপেক্ষে মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের নির্দেশনার আলোকে আবেদন করতে হবে। তবে সব শর্ত পূর্ণ করলেও এমপিওভুক্তির নিশ্চিত হবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়।
এমপিওভুক্তির জন্য অতিরিক্ত সচিবকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। কমিটির সুপারিশে এমপিওভুক্ত করবে মন্ত্রণালয়।
ন্যূনতম শিক্ষার্থী
গ্রামাঞ্চলে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ন্যূনতম শিক্ষার্থী থাকতে হবে ১৫০ জন। শহরাঞ্চলে হলে নূন্যতম ১৩০ জন। গ্রামাঞ্চলের জন্য প্রতি শ্রেণিতে ন্যূনতম ১৮ জন, শহর অঞ্চলে ন্যূততম ১৫ জন। গ্রামাঞ্চলে বার্ষিক পরীক্ষায় ন্যূনতম অংশগ্রহণ ১২ জন এবং শহরাঞ্চলে ১০ জন থাকতে হবে।
এমপিওভুক্তির গ্রেডিং পদ্ধতি
গ্রেডিং পদ্ধতিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির জন্য নম্বর ২৫, প্রতিষ্ঠানের জমি ও নামজারির জন্য নম্বর ২৫, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ মান ১৫, প্রতি শিক্ষকের জন্য মান ২, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ন্যূনতম ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য ৫ নম্বর এবং পরবর্তী ১০ জনের জন্য এক নম্বর করে নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার গড় ফলাফল শতকরা ৮০ শতাংশ বা তার বেশি হলে ৫ নম্বর, ৭০ থেকে ৭৯ হলে ৪ নম্বর, ৬০ থেকে ৬৯ হলে ৩ নম্বর, ৫০ থেকে ৫৯ হলে ২ নম্বর এবং ৫০ এর নিচে হলে কোনও নম্বর প্রাপ্য হবে না। এছাড়া খেলার মাঠ, ক্রীড়া সামগ্রী, গ্রন্থাগার বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট, প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীর এবং প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকতে হবে গ্রেডিংয়ে নম্বর পেতে হলে।
ভুল তথ্য দিয়ে এমপিওভুক্ত হলে এমপিওভুক্তি বাতিল এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শর্ত মেনে হাতে গোনা কয়েকটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হতে পারবে। সরকারি করা তো অনেক পরের কথা।