X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ : মারুফ ইসলামের ‘জীবন এখানে এমন’

শিশির মল্লিক
১৯ অক্টোবর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২০, ০৭:০০

প্রসঙ্গ : মারুফ ইসলামের ‘জীবন এখানে এমন’ ‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে

খুঁজি নাকো; এক নক্ষত্রের নিচে তবু—একই আলোপৃথিবীর পারে

আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,

প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’

—জীবনানন্দ দাশ

জীবনের উপলব্ধি কবির কাছে এমনই। অন্যের কাছে অন্যরকম। ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধিজাত বিষয়ের এক অনির্দিষ্ট, অনির্ধারিত অভিজ্ঞানের সমষ্টি। অতএব জীবন কোথায় কেমন তার উপলব্ধি লেখক মারুফ ইসলামের গল্প সংকলন ‘জীবন এখানে এমন’ এর সাথে মিল ও অমিলের উপলব্ধি তৈরি করবে বৈকি! প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনও মনে হতে পারে; আবার আরোপিতও মনে হতে পারে কোনো কোনো বিষয়। তারপরও কোনো গল্পই জীবনের বাইরের নয় বৈকি। তার গল্পের চরিত্ররা যেসব ঘটনার জন্ম দেয় সে সবের বাস্তবতা—বাস্তব ও পরাবাস্তবতা দ্বারা কতোটা নিয়ন্ত্রিত তার চুলচেড়া বিশ্লেষণ হয়তো করা যাবে কিন্তু তরুণ লেখক মারুফ যে অভিজ্ঞানে আঁকতে চেয়েছেন ‘জীবন এখানে এমন’ তার প্রেক্ষিতে বলা যায় এ আয়োজন আরও আয়ত ও গভীরতর করে নেওয়ার দাবি রাখে। কারণ এটি তার দ্বিতীয় গল্প সংকলন।

‘বাস্তবতা নিছক একটি বিভ্রম, যদিও এটি খুব স্থায়ী’—অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

একজন বিজ্ঞানীর উপলব্ধি বাস্তবতা সম্পর্কে এমন। যে বাস্তবতায় জীবনগুলো যাপন করে সে বাস্তবতার ভবিষ্যৎ মূল্য থাক বা না থাক ইতিহাসের ক্রম থেকে তারা কিছুতেই বাদ যায় না। তাই জীবনের ছবি আঁকতে গেলে কেমন জীবনের ছবি আঁকা দরকার তা লেখককে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হয়! কেননা কেউ যদি বাণিজ্যিক শিল্পী হতে চান তার একটা গতিপথ আছে; আবার যিনি সৃজনশীল শিল্পী বা লেখক হতে চান তার একটি আলাদা পথ আছে। আমরা ধরে নিই যে, মারুফ দ্বিতীয়টাই হতে চান—অতএব নিজেকে কেনা-বেচার বিষয়টি এ মাধ্যমে মুখ্য নয়; শিল্পটাই মুখ্য।

বর্তমানে আমরা যে সমাজ বাস্তবতায় বাস করছি তার মডেলটা কী? এখানের মূল সংকটটা কী? যে সংকট পুরো নাগরিক জীবনের সব অনুষঙ্গকে ধরে টানা-হেচড়া করে? কারা বা কাদের জন্য চরিত্রগুলো সংকটে পড়ে? যারা নিয়ন্ত্রক তারাও কেন নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? এসব কিছুরই রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট আছে; ফলে সে বাস্তবতাকে যিনি ভালো বোঝেন তার পক্ষেই কেবল যৌক্তিক চরিত্র ও ঘটনা নির্মাণ সম্ভব।

‘জীবনে যদি অগ্রগতি না থাকে সে জীবন অবাঞ্ছিত’—রোম্য রোলা

অতএব শিল্পে সমাজের এমন চরিত্রই উঠে আসা উচিত যার জীবনের গুরুত্ব অন্য জীবনকেও বাঞ্ছিত করে তোলে। কোন চরিত্র যদি অবাঞ্ছিতও হয় তার বাস্তবতাকে যদি লেখক যৌক্তিকভাবে তুলে আনতে পারেন তবে সে চরিত্রকে পাঠক গ্রহণ করে নেয়। আমরা মারুফের প্রথম গল্প ‘ছাতা’র মূল চরিত্র মঞ্জুর কথায় যদি বলি, সে প্রচলিত সমাজে নেতিবাচক চরিত্রই। একজন চোর, আবার চারিত্রিক সমস্যাও তার আছে। ঘরে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। যে সাথীকে তার পছন্দ, প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত হয়ে যে মেয়ে পল্লীতে আসে এবং যে এই নরক থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে মঞ্জুর মাধ্যমে; সে কিনা তাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে সান্তাহারে হোটেলে বিক্রি করার মতলব করে! আবার গল্পের প্রথম দিকে খালেক ব্যাপারির ছাগল চুরি করতে গিয়ে রাখাল বালককে খুন করে ফেলে। কারণ যাই হোক সে একজন খুনিও। কিন্তু তারপরও শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি সাথীকে সে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে মুক্ত করে দেয়।

এ বাস্তবতা থাকা অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু বাস্তবতাটিকে পাঠকের কাছে যৌক্তিক করায় মারুফ কতটা সফল?

আমরা মঞ্জুর মনের ভাবনা থেকে জানতে পেরেছি যে, তার জন্মের সময় মা মারা যায়। তার বড় বোন আঞ্জুর আদর যত্নেই বেড়ে উঠে। কিন্তু একদিন সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়; পরে জানা যায় সে পতিতা পল্লীতে বিক্রি হয়ে যায়। তার প্রতীক্ষায় থাকে সে।

যদি তার জীবনে এমন ঘটনা থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পতিতাপল্লীর প্রতি তার ঘৃণাবোধ এবং সহানুভূতি দুটোই থাকার কথা। কারণ এখানে যে নারীরা আসে তাদের আসার পেছনের গল্পগুলো কোনো না কোনোভাবে তার বোনের গল্পের মতো কিংবা কাছাকাছিই তো হয়। তাদের প্রতি একধরণের সহানুভূতিই তো থাকার কথা।—এ প্রশ্নগুলো আসার অবকাশ না থাকাটা লেখকের দক্ষতাকে প্রশ্নহীন করতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি।

এদিক থেকে দেখলে মারুফকে ভাবতে হবে চরিত্র ও বাস্তবতা নির্মাণে আরও যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা। 

জীবন সহজ নয়, জটিলও নয়-জীবন জীবনের মতো। আমরাই একে সহজ করি জটিল করি—হুমায়ূন আহমেদ

লেখক যদি এভাবে দেখে তার পক্ষে পক্ষপাতিত্বহীন জীবনের গল্প তুলে আনা সম্ভব। কারণ লেখক যে চরিত্র আঁকে তাকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করাতে হলে চরিত্রকে দিয়ে তার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী ঘটনা ও সংলাপ বলানো অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। আরোপিত করার বা হওয়া থেকে দোষমুক্ত থাকেন লেখক।

পরের গল্প ‘করুণ মুহূর্তগুলো’তে দাদা নাতির দারিদ্র জীবনে ভালো খাবার তীব্র বাসনা এবং ভিক্ষুক মোতালেব পেট ভরে খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। খুব সরলভাবে গল্প এগিয়েছে সরল পরিণতিও মারুফ এঁকেছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এরকম দারিদ্রতা কতোটা যুক্তি সম্মত? এখনকার সময়ে একজন ভিক্ষুকের আয় কম নয়। এক দু’শো টাকা কামানো তেমন বিষয় নয়, নাতি যে সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করে তার থেকেও যা আসে তাতে দাদা নাতি কখনো মফস্বলের মতো জায়গায় এক প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে খেতে পারে না—এমন কী? আর মাহফিল বা মসজিদে গরীবদের যে খাওয়া দেয় তা তো বছরে বহুবার খাওয়া যায়।

অন্যদিক থেকে দেখলে অপ্রাপ্তিই মানুষের জীবনকে কর্মময় বর্ণাঢ্য করে তোলে এবং ততদিন মানুষ ইতিবাচক থাকে যতদিন তার জীবনে সংগ্রাম থাকে। জীবনে যখনই সাফল্য আসে, আসে তৃপ্তি; তখন শুরু হয় মানুষের অধঃপতন কিংবা পতন। তখন সে বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে অর্থহীন। এ গল্পের দার্শনিক দিক বিচার করলে ভিক্ষুক মোতালেবের জীবনের যে পরমতৃপ্তি কয়েক প্যাকেট খাবারের মাধ্যমে সে পেয়েছে। এবং যে সুখানুভব সে উপলব্ধি করে। কর্মহীন বিশ্রামের যে সুযোগ লাভ করেছে তারপর তার আর কী চাওয়া থাকতে পারে। এর পরেরটা তো পুনরাবৃত্তি। পুনরাবৃত্তির মধ্যে ক্লান্তি ছাড়া কিছুই থাকে না। কিন্তু মোতালেবের মতো মানুষের জীবন এমনই যে যারা শুধুমাত্র জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যতটুকু গ্রহণের দরকার তার বেশি তারা পায় না। বেশিটা তাদের চাওয়াও নয়। ফলে মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক পরিণতি তাদের জীবনে নানা ছুতোয় সময়ে অসময়ে চলে আসে। মোতালেবের চলে যাওয়াটা পাঠকের মধ্যে একধরণের সহানুভূতির উদ্রেক করে। কিন্তু মিন্টু যার জীবন পড় আছে অনাগত দিনের তার কী হবে আমরা কেইই জানি না। লেখক নিজেও তার কোনো আভাস দেননি।

গল্পের ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক সমাজবাস্তবতার অসঙ্গতির প্রতি যে ঈঙ্গিত করেন এবং সেটা যদি খুব যৌক্তিকভাবে করতে পারেন সেক্ষেত্রে লেখককে সফল বলতে হবে। মারুফ এ গল্পে সরদার বাড়ির বড় ছেলে আকবর সরদারের বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আস্ফালনের প্রতি ঈঙ্গিত করেছেন।যেমন—

‘হামরা ক্ষমতায় আসার পর কাউয়াতলার কত উন্নয়ন হছে, দিখিছিন তোমরা? কাউয়াতলা এখন মধ্যম আয়ের গাঁও। আর বিশ বছরের মধ্যে এডা উন্নত আয়ের গাঁওতে পরিণত হবে। তখন কাঙালি ভোজ খিলানোর মতো একডাও মানুষ পাওয়া যাবে না, হামি হলপ র্কযা কচ্ছি আজ। হামার কতা যদি সত্যি না হয়, তোমরা হামার কান কাট্যা কুত্তাক খিলাইও সেদিন।’

সমাজ ও রাজনৈতিক অসংঙ্গতিকে ব্যাঙ্গ করার মাধ্যমে লেখক ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরেন যাতে অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠতে সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তি সচেতন হয়। আশা করি এ কাজটি মারুফ এ গল্পের একটি ঘটনার মাধ্যমে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন।

‘নামহীন শোক’ গল্পে লাল্টু নামক চরিত্রটিকে লেখক মারুফ যেভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তাতে আমাদের নিম্ন আয়ের বা সমাজের নিচুতলার মানুষের স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান বলা যায়। লাল্টুর মতো সন্তানদের বাঁচার জন্যে ধ্বংসাত্মক কিংবা বিকৃত যে কোন কিছুতেই আটকে যেতে পারে সেটা ইচ্ছা হোক বা অনিচ্ছায়। লাল্টুর শরীর বিক্রির চিন্তাকে বিকৃত বা অযৌক্তিক যাই মনে হোক; তাতে লাল্টুর কিছু আসে যায় না। এর পিছনে তার যুক্তিটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আবার পিয়ারা বানুকে নিয়ে কাউয়াতলী থেকে ঢাকায় এসে মা ও দুলাভাইয়ের কাছে জায়গা না পেয়ে চন্দ্রিমায় পুলিশ বা চৌকিদারের কাছে নিজে ও পিয়ারার ইজ্জত হানি, তার জেল; রাষ্ট্র এখানে প্রত্যক্ষ নিপীড়ক এবং আপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা নিচুতলার মানুষের জীবনের প্রাত্যাহিক ঘটনা। এ বাস্তবতা তো মধ্যবিত্তের চোখেও পড়ে কোর্ট কিংবা থানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায় একদল সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অসহায় মানুষের জীবনে গোদের উপর বিষফোঁড়া এই রাষ্ট্র। লেখক মারুফ এই ছোট গল্পটির মধ্যে চমৎকারভাবে এই শ্রমজীবী মানুষের জীবনের ছবি এঁকেছেন।

‘সাধিত রাধিকা’ গল্পটি গল্পই। প্রেম নামক তরল বিষয়ের রূপের সাধিত অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে।

লীলাক্ষেত্র নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ব্যর্থতার বা হারানোর গল্প। বাস্তব ও স্বপ্নের টানাপোড়েন। মিঠুন মণ্ডলের ছোট্ট স্বাভাবিক চাওয়াটাও অনিশ্চয়তার দোলাচালে খুন হয়ে যায়। হয়তো বা আবারো তাকে বাঁচার চেষ্টা করে যেতে হবে। সেখানে সফল হবে কি হবে না তার কোনো কিছুই পাঠক জানে না, কারণ সমাজে গ্যারান্টির কিছুই নেই, দীর্ঘশ্বাস ছাড়া।

‘দ্বিধা’ গল্পটি খুব সাদামাটা ঢঙ্গে এগিয়েছে। এখানে নায়কের নামটা আমরা জানতে পারিনি। যে ছেলে মিতাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। তার অন্যকে পছন্দ থাকায় সম্পর্কটা এগোয়নি। মা-বাবার পছন্দে ঠিক করা পাত্রীর সাথে যখন কথা এগিয়ে যাচ্ছে সেই মুহুর্তে মিতার মার অনুরোধ; দু’টো সুযোগই তার সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এখন কোন পথে যাবে সে? দুটো অপশনের যে কোনটিই হতে পারে।

‘আমরা এমনই এসে ভেসে যাই’। তরুণদের অনিশ্চিত ও স্বপ্নহীন জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে আঁকা এ গল্পটিতে রবি চরিত্রটির একটা অস্পষ্ট চেহারা পাওয়া যায়। অনেকদিন পর দেখা হলেও গল্পটা যার মুখ দিয়ে শুনছি তার আগ্রহ থাকলেও কেমন নিস্পৃহ থাকে রবি। সিগেরেট আনতে গিয়ে ফিরে এসে বন্ধু আর তাকে পায় না। রবির ভগ্ন পারিবারিক গল্পের আভাস আমরা পেয়েছি। মা অন্য একজন পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। পরদিন ভোরে পেপারে একটি মেয়ের খুনের ঘটনার সাথে রবির ছবি ছাপা সহ ধাধা লাগার মতো কথক বন্ধু সুমনকেও বলতে পারে না রবির বিষয়টি। সুমনও কী যেন বলতে এসে না বলে পালিয়ে যায়। কোন চরিত্রেরই কোন ডাইমেনশন পাওয়া যায় না। একটা অস্পষ্টতা, অস্থিরতার আভাস আছে তাতে। গল্পের উদ্দেশ্যটা ধরা যায় না। একটা পেইন্টিংএর মতো কিছু অবয়বের আভাস শুধু ফুটে উঠেছে কেবল।

‘একটা সস্তা প্রেমের গল্প’ সেঁজুতি নামের মেয়েটি কিভাবে পুরুষের চাওয়া-পাওয়ার কাছে বলি হয় তার ছবি। কবির সাথে সম্পর্ক কিন্তু তাকে পছন্দ না হওয়ার সামাজিক গ্যাপ আবার শাকিলকে পছন্দ করার মাঝে সামাজিক ফাঁক না থাকলেও শাকিলের মা-বাবার সম্পর্কেও জটিলতা। বাবার অনৈতিক জীবন যাপন, তার বৈধ বাপ না থাকা, বাইরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টাকা ম্যানেজ করা এসবের জন্য কবির হয়ে সেঁজুতিকে বলি দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা শাকিলকে একটা নেতিবাচক মানুষ হিসেবে তুলে এনেছেন লেখক। কবিও তার বাইরে নয়। চাওয়া-পাওয়ার এসব বেমিল কিভাবে জীবন জীবনের প্রতি নির্মোহভাবে নির্মম হতে পারে তার ছবি হয়ে উঠেছে গল্পটি।

‘এসি’ গল্পটি একটি নিম্ন আয়ের লোকের পরিবারে স্ত্রী সন্তানদের কষ্টের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতির গল্প। সামির সাহেব টিনসেডের বাসায় থাকলেও অফিসে এসির মধ্যে থাকেন। তিনি অপরাধবোধে ভুগতেন বলে প্রায় সময় এসি বন্ধ করে দিতেন কেন এটা করেন কেউ তা জানতেন না। কিন্তু কলিগ ফারুক সাহেব সরাসরি সামির সাহেবের বাসায় এসে দেখেন সামির সাহেব টিনসেডের বাসায় এসি লাগাচ্ছেন। কেন এটা করছেন তার ব্যাখ্যায় তিনি স্বীকার করেন যে, আমি অফিসে এসিতে থাকি অথচ আমার বউ-বাচ্চারা কষ্টে থাকেন। এটা ভালো লাগতো না বলে তিনি বারবার এসি বন্ধ করতেন। ফারুক সাহেব তার কথায় সাহানুভূতি প্রকাশ করেন, তার চোখ ভিজে আসে। ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়ার সংঘাত মানুষকে সুন্দর করে তুলে সন্দেহ নেই। কিন্তু যেটা সামর্থের বাইরে সেটা পূরণ করতে গেলে সামর্থ বাড়িয়ে নিতে হয় নতুবা দুর্নীতির পথে পা বাড়াতে হয়। আমাদের বর্তমান সমাজে সামর্থ বাড়িয়ে নেয়ার গল্পগুলো দুর্নীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাকে আমরা এখন কিছুই মনে করি না, মনে করি স্বাভাবিক। লেখকের গল্পটি আমাদের কোনো দিক নির্দেশ করে না যদিও। শুধু বউ-বাচ্চার প্রতি তার অপরিসীম সিমপ্যাথেটিক ব্যাপারটি প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমরা জানি, এখানে এই একান্ত ব্যক্তিগত জায়গায় এসে মানুষ এসব ছোটখাট বৈষয়িক চাহিদাগুলোর মধ্যে হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় অন্যের সাথে নিজের সংহতির যোগ। প্রশ্ন রেখেই আপাত আমরা সামির সাহেবের অনুভূতিকে সমর্থন জানিয়ে যায়।

‘একদিন বৃষ্টিতে সন্ধ্যায়’ গল্পটিতে সঞ্জুর প্রেমিকা পুস্পকে খুঁজে না পাওয়া তেরো মেয়ের পাচার হওয়ার সংবাদ; যার মাঝে পুস্প নামের একটি মেয়ের নাম পাওয়া গেছে। গল্পের কথক তার বন্ধু সঞ্জুর প্রেমিকা পুস্পকে পাচার করেছে পেশাগত কারণে। এ বস্তবতা সমাজে ঘটে চলেছে অহরহ। না হোক সেটা পরিচিত, যে কাজটা করছে সে তো অন্যের বোন প্রেমিকা কাউকে না কাউকে তো অন্ধকার জগতে পাঠাচ্ছে নিজে ভালো থাকার জন্যে। এ বাস্তবতাকে পাঠক কীভাবে নেবেন বা দেখবেন তা তারাই ঠিক করবেন। লেখক হিসেবে মারুফ কোন গল্পেই সিদ্ধান্তের দিকে যাননি, যেতে চাননি।

‘ক্রান্তিকাল’ গল্পে শিশিরের বাড়ি ফেরা, খুন হয়ে যাওয়া মা-বোন-বাবার ঘটনা, যার কোনো ব্যাখ্যা সে বলতে পারে না। তাকে আর তার মা-বাবার কাছে স্বপ্নের কথা বলা হয়ে ওঠে না। বেকার যুবকের চাকুরি পাওয়ার আনন্দে বাড়ি এসে সুসংবাদটা সরাসরি দেয়ার প্রত্যাশায় তার গ্রামে ছুটে আসা। বাস্তব জীবনের নির্মমতা তাকে টুকরো টুকরো করে নিঃস্ব করে দেয়। স্বপ্নভঙ্গের এ গল্পটি আমাদের সমাজের নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরে।

‘জীবন এখানে এমন’ সংকলনের শেষ গল্প এটি। এখানে নশরতপুর স্টেশনের আত্মকথনের মাধ্যমে আমরা জানতে পায় আনার পাগলা রইচ মিন্থির পালক সন্তান যাকে স্টেশনে এক নারী রেখে গিয়েছিল তার কোলে। নিঃসন্তান রইস ও তার স্ত্রী নিজ সন্তান মনে করে পেলে বড় করেছে। সে ট্রেনে কাটা পড়ে নির্মম মৃতুবরণ করেছে। তার স্ত্রী শরীফ নামের একটি ছেলের সাথে ট্রেনে চড়ে পালিয়ে গেছে। সর্বশেষ আনারের কোন ওয়ারিশ থাকে না। এটিও ব্রাত্য জনগণের নির্মম জীবনের গল্প। যেখানে মানুষের সম্পর্কগুলো মানবিক ও অমানবিকতা পাশাপাশি জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকে। তার নিপুন ছবি মারুফ পক্ষপাতহীনভাবে তুলে এনেছে।

এখন বলা যায় যে, লেখক মারুফের গল্প বলার ধরণে একটা সাবলীলতা আছে। ঝরঝরে মেদহীন ভাষায় তিনি পাঠককে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারেন। দৃশ্য রচনায় সুপটিয়সী মারুফ প্রতিটি গল্পে এই দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন সন্দেহাতীতভাবে যা একজন কথাশিল্পীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ