২০১১ সাল। একাদশ শ্রেণির ছাত্র নজরুল ইসলাম। স্থানীয় একটি কলেজের পাশে আপেল কুলের (বরই) বাগান দেখে তারও শখ জাগে কুলের বাগান করার। বাগান মালিককে নিজের ইচ্ছের কথা বলেন। পান পরামর্শ। কিশোর মনের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আর বিলম্ব করেননি নজরুল। সে বছরই পৈত্রিক জমিতে রাজশাহী আপেল কুল জাতের ৭৫টি চারা দিয়ে বাগান শুরু করেন তিনি। আর পেছনে ফিরতে হয়নি। নজরুলের কুল বাগান এখন এলাকায় দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। ছাত্রাবস্থায় বাগানের কুল বিক্রি করে নিজের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে পরিবারকে সহায়তা করেছেন, বছর বছর কিনছেন জমিও। কুল বিক্রির টাকায় সম্প্রসারিত করেছেন বাগান, পূরণ করছেন নিজের ইচ্ছা। বর্তমানে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পরীক্ষার্থী নজরুল বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করেছেন এই আপেল কুল বিক্রির উপার্জন দিয়েই। আপেল কুল দিয়ে জীবনের প্রায় সব কূল জয় করছেন নজরুল।
ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামে নজরুল ইসলামের বাড়ি। ওই গ্রামের আছির উদ্দিন- সুন্দরী খাতুন দম্পতির ছেলে তিনি। গ্রামে পৈত্রিক জমিতে আপেল কুলের বাগান করে নিজের ভাগ্য বদলের উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম। তার বাগানে আপেল কুলের ফলন দেখে খোদ কৃষি বিভাগও কপালে চোখ তুলেছে। প্রায় চারশ’টি বড়ই গাছে ঝুলছে লাখ লাখ টাকার আপেল কুল!
নজরুল ইসলাম জানান, ২০১১ সালে মাত্র ৭৫টি রাজশাহী আপেল কুলের গাছ দিয়ে তার বাগানের শুরু। প্রতিবছর গাছপ্রতি প্রায় তিন মণ করে (পুরো বাগানে ৯ টন) আপেল কুলের ফলন পেতেন তিনি। এরপর ইউটিউবে শাইখ সিরাজের একটি প্রতিবেদনে কাশ্মিরি আপেল কুল নিয়ে প্রতিবেদন দেখে অনুপ্রাণিত হন। ২০২০ সালে যশোর থেকে ৩২০টি কাশ্মিরি আপেল কুলের চারা কিনে এনে সেই চারায় বাগান সম্প্রসারিত করেন নজরুল। মাত্র ১০ মাসে সেই ৩২০টি চারা এখন ফলে পরিপূর্ণ। প্রতিটি গাছে প্রায় ৪০-৪৫ কেজি কাশ্মিরি আপেল কুলের ফলন হয়েছে বলে জানান নজরুল।
নজরুল বলেন, ‘রাজশাহী আপেল কুলের গাছগুলো বেশ বড় আকারের হয়। কিন্তু কাশ্মিরি আপেল কুলের গাছ অনেক ছোট। উভয় জাতের ফলন অত্যন্ত বেশি। রাজশাহী আপেল কুলের প্রতি গাছে প্রায় তিন মণ করে এবং কাশ্মিরি আপেল কুলের প্রতি গাছে ৪০-৪৫ কেজি করে ফলন পাওয়া যাচ্ছে। সে হিসেবে এবছর বাগানে প্রায় সাড়ে ২১ টন আপেল কুলের ফলন পাওয়ার প্রত্যাশা করছি।’ ইতোমধ্যে ফল বিক্রিও শুরু করেছেন বলে জানান এই উদ্যোক্তা।
রাজশাহী আপেল কুল ১৬শ’ টাকা মণ এবং কাশ্মিরি আপেল কুল ১৫শ’ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে এবার বাগান থেকে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা উপার্জন হবে বলে আশা করছেন নজরুল।
তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘এক একর ৪২ শতক আয়তনে আমার বাগান। এই বাগান দিয়েই আমার পরিবারের সব চাহিদা মেটে। প্রতি বছর কিছু কিছু জমিও কিনছি আমি।’
বাগানে গাছের পরিচর্যা সহজ ও খরচ অত্যন্ত কম জানিয়ে নজরুল বলেন, ‘ চারার মূল্য বাদে এ বছর আমার বাগানে সেচ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকসহ মোট সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে। কিন্তু মুনাফার পরিমাণ অনেক বেশি।’
বেকারদের জন্য আপেল কুল চাষ কতটা সহজসাধ্য- এমন প্রশ্নে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই সফল উদ্যোক্তা বলেন, ‘কুল বাগানে তেমন কোনও পরিশ্রম নেই, খরচও অত্যন্ত কম। এটা উপার্জনের অনেক সহজ একটা উপায়।’ বন্যায় বাগানে আড়াই ফুট জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও তার বাগানে চারার কোনও ক্ষতি হয়নি বলেও জানান তিনি।
নজরুলের নিজ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তার বাগানে সফলতা এলেও বর্তমানে উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা নিয়মিত তার বাগানের খোঁজ রাখছেন। তার উদ্যোগকে সমর্থন ও উৎসাহ দিতে সম্প্রতি তাকে মাল্টা বাগানের জন্য ১২০টি মাল্টা চারা দিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। এতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত এই উদ্যোক্তা।
নজরুল জানান, ‘উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিনু আক্তার আমার আপেল কুল বাগানের সফলতা দেখে আমাকে মাল্টা চাষে অনুপ্রাণিত করেছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমাকে মাল্টা প্রদর্শনীর জন্য চারা দেওয়া হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমি মাল্টা চাষেও সফলতা পাবো।’
রাজীবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম রায়হান বলেন, ‘নজরুলের সফলতায় আমরা বিস্মিত। একজন তরুণ উদ্যোক্তা শুধুমাত্র একাগ্রতা দিয়ে এই ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। উপজেলায় তার এই সাফল্য অদ্বিতীয়। শিগগিরই হয়তো সে কুলের চারার উৎপাদনেও সাফল্য পাবে।’
’জেলার চরাঞ্চলের তুলনামূলক উঁচু জমিতে আপেল কুলের চাষ অনেক বেকার যুবকের আয়ের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। নজরুলের বাগান সেরকমই একটি দৃষ্টান্ত।’ যোগ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।