X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
স্মরণ

উত্তর ‘জানে আলম’!

আহসান কবির
১৪ মার্চ ২০২১, ১৫:৪৪আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২১, ১৬:৫৭

আমার নিরানন্দ কিংবা বেকার সময়ের সঙ্গী ছিলেন সংগীতশিল্পী জানে আলম! জীবনের ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’ সময়গুলোতে আমি চলে যেতাম এই আনন্দময় মানুষটার কাছে।

বেশিরভাগ সময় তাকে খেপাতাম, তিনি বিরক্তির চূড়ান্ত চূড়ায় উঠলে আমি বা আমরা কেটে পড়তাম। যতক্ষণ না উনি বলতেন, ‘শিল্পী হিসাবে আমারে দেখছাস? (উনি এভাবে উচ্চারণ করতেন) যদি রিপোর্টারের চোখে দেখতে চাস তাইলে চইলা যা এক্ষুনি।’ আমি বা আমরা বুঝে যেতাম, জানে আলম ভাই খেপেছেন। আমরা কেমন একটা আনন্দ নিয়ে চলে আসতাম। চলে আসার আগে বলতাম, ‘আপনার ৪ হাজার গানের একটা হওয়া উচিত ছিল—রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো (চুমকি চলেছে একা পথে)।’

জানে আলম ভাই হয়তো অনেক কিছু বাড়িয়ে বলতেন। এই বলার ভেতরে গর্ব বা অহংকার ছিল না, এক ধরনের সরলতা ছিল। একদিন বললেন, ‘আমার গানের সংখ্যা অনেক।’ আমি জানতে চাইলাম, কত? উনি বললেন, ‘৪ হাজার’। আমি কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম। সবাই জানালো জানে আলম ভাই সাধারণত ৪ হাজারের নিচে নামেন না। একদিন এক ক্যামেরাম্যানকে সাথে করে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম জানে আলম ভাইয়ের সামনে। ভাই খুব খুশি। ভাবলেন তাকে নিয়ে রিপোর্ট হবে। অনেক কথা বলার পর জানতে চাইলাম, আপনার গানের সংখ্যা কত? যদি ৪ হাজার হয় তাহলে সেটা কেমনভাবে প্রমাণ করা যাবে? এই ধরেন ক্যাসেটের যুগে এক ক্যাসেটে ১০ বা ১২টা গান থাকতো। ৪ হাজার গান থাকলে কয়টা ক্যাসেট লাগে? আপনার কয়টা ক্যাসেট বা অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে? এর বাইরে রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচার হওয়া গানের সংখ্যা কত? জানে আলম ভাই চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘শিল্পী হিসাবে আমারে দেখছাস? যদি রিপোর্টারের চোখে দেখতে চাস তাইলে চইলা যা এক্ষুনি।’

আমরা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম। জানে আলম ভাই খেপেছেন। তাকে খেপানোর অনেক অনুষঙ্গ পেয়ে যেতাম। পাওয়া মাত্রই প্ল্যান করে তার কাছে যেতাম এবং শুরু করতাম খেপানো। অভিনেতা জাহিদ হোসেন শোভন (তাকেও জীবনে বহুবার খেপিয়েছি)। তার নাম জাহিদ হাসান শোভন লিখলেই সে খেপে যেত। বাংলা সিনেমায় সে ‘আকাশ’ নামে ‘নায়কগিরি’ করতো। আমরা জাহিদ হাসান আকাশ বললে সে আরও খেপে যেত। শোভনের সঙ্গে একবার দেখা জানে আলম ভাইয়ের। সম্ভবত দুজনেই ‘মানিকগঞ্জিয়ান’ (মানিকগঞ্জ বাড়ি)। আলোচনার কথাবার্তায় আমার নাম উঠে এলে জানে আলম ভাই বললেন, ‘আরে চুল নাই আহসান কবিরের কথা বলছাস? ও তো আমার আপন ভাই!’

এরপর জাহিদ হোসেন শোভনের সাথে দেখা হলে সে আমার কাছে জানতে চাইলো, ‘তুমি যে জানে আলম ভাইয়ের আপন ভাই সেটা তো জানতাম না!’ শোভনের সাথে কথা শেষ করে আমি আবারও আনন্দ নিতে চলে গেলাম জানে আলম ভাইয়ের কাছে। জানতে চাইলাম, আমি আপনার আপন ভাই হইলাম কবে? এই প্রথম জানে আলম ভাই কিছু বললেন না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন!

এরপর থেকে জানে আলম ভাই আমাকে দেখলেই কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকতেন। ভাবতেন নতুন করে আমি আবার কী বলবো? একবার এক টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জানে আলম ভাইয়ের সাথে দেখা। আমার সাথে হাত মিলিয়েই মঞ্চে উঠে বললেন, ‘আমার আজ একটা গান গাইবার কথা।’ সেই গানটা গাচ্ছি বলেই শুরু করলেন—একটি গন্ধমেরও লাগিয়া আল্লায় বানাইলো দুনিয়া...। গান শেষে তুমুল করতালি। সেই আনন্দের বন্যায় ভেসে জানে আলম ভাই ঘোষণা দিলেন, ‘আমার আরও একটি জনপ্রিয় গান গাইবো। যদিও একটামাত্র গান গাইবার কথা, কারণ অনেক শিল্পী আছেন এখানে। তবু আরেকটা গাইছি।’ এই বলেই শুরু করলেন—গ্রামেরই নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান...।

গান শেষে মঞ্চ থেকে নিচে নেমে এলে আমি জানতে চাইলাম, ‘গ্রামেরই নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ আপনার গান কী করে হলো? এটা তো শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত গান। ঢোক গিললেন জানে আলম ভাই। কী যেন ভেবে বললেন, ‘যখন রবীন্দ্রসংগীত গাই গানটাকে তখন আপন মনে করি। মনে করি গানটা আমার জন্যই লেখা হয়েছে। ধরে নে শাহ আবদুল করিম গানটা আমার জন্যই লিখেছেন’—বলেই হাঁটা শুরু করলেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চাই। কবে গাইবেন? জানে আলম ভাই এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না।

গত পাঁচ ছয় বছর আমাকে দেখলে মাঝে মাঝে খেপে যেতেন, অভিমান করতেন। একজীবনে তাকে খেপানো ছাড়া আমি নাকি আর কিছু করিনি। এরমাঝে একবার ডিফারেন্ট টাচ ব্যান্ডের জিয়াউল হাসান পিয়ালের রেকর্ডিং স্টুডিও ‘তানপুরা’তে জানে আলম ভাইয়ের সাথে দেখা। আড্ডা জমলেও মনে হলো জানে আলম ভাই অতি সাবধানী। মন খুলে কথা বলছেন না। সংগীতশিল্পী শ্রদ্ধেয় নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কথা উঠলো আড্ডায়। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন জানে আলম ভাই। বললেন, ‘ওস্তাদ নিয়াজ চৌধুরীর জীবনের একটা সেরা গান কিন্তু আমার।’ আমি লুফে নিলাম কথাটা। বললাম, কোন গানটা? জানে আলম ভাই বললেন, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’! আমি বললাম, এই গানটা আপনার ৪ হাজার গানের ভেতরের কোনও গান না। এটা শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী ও সুরকার লাকি আখান্দের সুর করা। যদিও এই অ্যালবামটা আপনার গানের কোম্পানি থেকে বের হয়েছে।

এবার একটু আগেভাগেই খেপে গেলেন জানে আলম ভাই। বললেন, ‘এই কবির তুই কি আমার চেয়ে বেশি জানছাস? আমি যদি লাকি ভাইরে ভালোই না বাসতাম তাইলে কি উনি এমন ভালো গান সুর করতে পারতেন?’ আমি জানে আলম ভাইয়ের কথা শুনে তব্দা খেয়ে গেলাম। সত্যি তো! ভালো না বাসলে কি এমন সৃষ্টি সম্ভব? আমি জানতে চাইলাম, আলম ভাই আপনি কী আমারে লাকি ভাইয়ের মতো ভালোবাসবেন?

জানে আলম ভাই এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। শেষদিকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। লেখক ও ছড়াকার পলাশ মাহবুব একবার সিদ্ধান্ত নিলো যে সে মজাদার প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে একটা টেলিভিশন শো করবে। টেলিভিশন শো—‘উত্তর জানে আলম’! আমি পলাশ মাহবুবকে নিয়ে ছুটলাম জানে আলম ভাইয়ের কাছে। ‘উত্তর জানে আলম’ টিভি শো’র কথা শুনে হো হো করে হাসা শুরু করলেন জানে আলম ভাই। তারপর বললেন, ‘কবির আমাকে শিল্পী হিসেবে দাম দেয় না! কমেডি মার্কা প্রশ্ন নিয়া টানাটানি করতে আসে মাঝে মাঝে!’ এরপর খুব আবেগ নিয়া প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা কবির আমার গান কি কখনও মনোযোগ দিয়া শুনছাস? একটা গানও কি তোর ভালো লাগে না?’ আমি বললাম, অবশ্যই লাগে। এই যেমন, যাইবো নারে যাইবো না কপালের লিখন/ কোথায় আমি পইড়া রইছি কোথায় ছমিরন!

জানে আলম ভাই আর কোনও কথা বললেন না। কোনও প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। ছমিরনের কথা মনে পড়ে গেলো কিনা বুঝলাম না!

এরপর বহুদিন গেছে। জীবনের প্রয়োজনে যে যার মতো ব্যস্ত থেকেছি। জানে আলম ভাইয়ের কাছ থেকে উত্তর জানা হয়নি যে ছমিরন বলে তার জীবনে কেউ ছিল কিনা? না হলে এমন বুকভাঙা গান কীভাবে সৃষ্টি হয়? জানা গেলো না করোনার দিনগুলোতে নতুন কোনও সুর তিনি সৃষ্টি করেছিলেন কিনা। জানা গেলো না আমার মতো তার আপন ভাইয়ের সংখ্যা কতজন?

কিছু দিন আগে তার স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। জানা গেলো না জানে আলম ভাই তার চিরচেনা ‘গন্ধমের’ রাজ্যেই চলে গেলেন কিনা! জানা গেলো না আসলে তিনি কতগুলো গান গেয়েছিলেন কিংবা সুর করেছিলেন।

গানের ক্যাসেট বা সিডি প্রকাশের মাধ্যমে অনেক শিল্পীর স্বপ্ন (দোয়েল প্রডাক্টস ছিল তার গানের কোম্পানি) তিনি পূরণ করেছিলেন। দিলখোলা হাসি দিয়ে জানতে চাইতেন, ‘কেমন আছাস?’ আজ আমি শুধু জানতে চাই, আপনি কেমন আছেন জানে আলম ভাই? বিশ্বাস করেন, আমি আর কোনোদিন কোনও কমেডি মার্কা প্রশ্ন তুলে আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি কেমন আছেন ভাই?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: জানে আলম ভাই আমাকে তার গানের ‘সিডি-সমগ্র’ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘শোন আমার কতো গান আছে সেটা গোনা বাদ দে। আমি মরে গেলে আমাকে নিয়ে লিখবি। তুই আজম খানকে নিয়া লিখছাস! এন্ড্রু কিশোররে নিয়া লেখাটা পইড়া মনে হইছিল তুই গান শুনতে শুনতে ঘুমাস, গান শুনতে শুনতে খাওয়া দাওয়া করাস! কেউরে বাঘে খায়, কেউরে নেশায় খায়, কিন্তু খুব কম মানুষ আছে যারে গানে খায়! শোন, গান যারে খায় সেই-ই শিল্পী, বুঝছাস?’

গান যারে খায় তার জীবনটাও কি গানের মতো হয়? জানে আলম ভাই আপনি যেখানে আছেন সেটা কি গানের জগৎ? আপনি কি এখনও গান নিয়ে আছেন কিংবা গান কি এখনও আপনাকে কুরে কুরে খায়?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী