X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

একজন তরুণ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাতার গল্প

জুবলী রাহামাত
০৬ এপ্রিল ২০২১, ১৪:০৭আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০৯

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন একটি ধারা যুক্ত হতে যাচ্ছে। সেটি হলো পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। পূর্বে অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ হলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোর সাহস কেউ দেখায়নি। পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করার প্রথম যে উপাদান সেটি হলো দক্ষ অ্যানিমেটর। সেটির অভাবেই বাংলাদেশে এতদিনে কোনও পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি হয়নি। কিন্তু এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও একজন তরুণ স্বপ্ন দেখেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করার। সেটি এখন মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

বলছিলাম বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘মুজিব আমার পিতা’র কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী  সামনে রেখে এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকর্ম ও দর্শন পৌঁছানোর জন্য আইসিটি ডিভিশনের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এটিই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম দ্বিমাত্রিক (টু'ডি) অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ের অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটি।

‘মুজিব আমার পিতা’ অ্যানিমেশন  চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান প্রোলেন্সার স্টুডিও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছে। 

বর্তমানে অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করলেও এস এম রানা তার ক্যারিয়ার শুরু করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র,  প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে। ক্লাসের খাতায় জায়গা পেতো বিভিন্ন রঙের মিশেলের চিত্রকর্ম। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তৈরি করেছিলেন তার প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকে ভর্তি হয়ে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। কিন্তু  শিল্পী মন নিয়ে রসায়নের জটিল-জটিল বিক্রিয়াগুলো অসহ্য লাগতে শুরু করে। ‘আমি ভিজ্যুয়াল মিডিয়া নিয়ে কাজ করা লোক। তাই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগে’- বলেন এস এম রানা। 

গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগে ভর্তি হলেও রানার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে আগ্রহের জায়গা থেকে তিনি যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদে। এখানে যুক্ত হয়েই এস এম রানা বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র ও পরিচালকদের সম্পর্কে  জানতে পারেন। সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান, আলমগীর কবীরের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জেনে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করেন। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাণে ধীরে ধীরে এম রানা তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। শুরুটা হয়েছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও  প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে। সাথে সমানভাবেই চলতো আঁকা।

একজন তরুণ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাতার গল্প

‘আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ কক্ষে লাইব্রেরি রয়েছে, যেখানে চলচ্চিত্র সম্পর্কে প্রচুর বই রয়েছে। যেই বইগুলো আমি দু একদিনের মধ্যেই শেষ করে আবার নতুন বই ইস্যু করতাম’ বলেন রানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য হয়েই  রানার চলচ্চিত্র দেখার চোখ তৈরি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই রানা নির্মাণ করেছেন টেলিভিশন নাটক। ‘অনুচ্চারিত দাহ ও পুতুল বৃত্তান্ত ‘ নাটকগুলো প্রচারিত হয়েছিল দেশ  টিভিতে। চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার চিন্তা থেকেই রানা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণে  মনোযোগী হন। নির্মাণ করেন ‘জার্নি বাই ক্যামেরা, নেভার সিন গ্রিন ও শহীদ মিনার’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এস এম রানা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে দেশীয় ও বৈশ্বিকভাবে পরিচিত পান ২০১৪ সালে তার নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘রাইট টু ওয়াটার’ এর মাধ্যমে। পানির ব্যবহার ও পানির জন্য  মানুষের যে ব্যাকুলতা তা নিয়েই নির্মিত হয়েছে রাইট টু ওয়াটার। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য রানা পেয়েছেন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে আছে জার্মানির বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গ্রিন ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, ইতালির রিভার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বেস্ট শর্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এবং ইস্তাম্বুলের কিসাকেস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বেস্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড।

একজন তরুণ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাতার গল্প

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য এস এম  রানা ২০১২ সালে ‘অপেরা ঢাকা’ নামক স্টুডিও তৈরি করেন। ২০১৭ সালে অপেরা ঢাকা’র নাম হয় প্রোলেন্সার স্টুডিও। এখানে এক ঝাঁক তরুণ অ্যানিমেটর নিয়ে কাজ করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। প্রোলেন্সার মূলত ফ্রিল্যান্সিং অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করে। তাদের অধিকাংশ গ্রাহকই বিশ্বের বিখ্যাত সংগীত ব্যান্ড। প্রলেন্সার  রেইন, হল অব অকস  এর লিরিক ভিডিও তৈরি করেছে। 

কীভাবে মুজিব আমার পিতা নির্মাণ করার চিন্তা মাথায় আসলো? জানতে চাইলে রানা বলেন, ‘একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় আমি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারি। সাথে  গ্রাফিক্স নোভেল ‘মুজিব’ টিমে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। ২০১৭ সালে যখন প্রধানমন্ত্রীর লেখা শেখ মুজিব আমার পিতা বইটি পড়ে শেষ করেছি, তখনই সাথে সাথে স্টোরি বোর্ড তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। আইসিটি ডিভিশনের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ভাইকে আমার এই আগ্রহের বিষয়টি জানালে তিনি তাঁ মন্ত্রণালয় থেকে এটি প্রযোজনা করেছেন।’ 

প্রায়  তিন বছর লেগেছে মুজিব আমার পিতা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণে। সোহেল মোহাম্মদ রানার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল অ্যানিমেটর তৈরি করা। কারণ দেশে অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। মুজিব আমার পিতা নির্মাণে সোহেল মোহাম্মদ রানার টিমে প্রায় ৪০ জন অ্যানিমেটর কাজ করেছেন। কর্মশালার মাধ্যমে প্রায় ৩৭ জন নতুন অ্যানিমেটর তৈরি করেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। মুজিব আমার পিতা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটির দলে প্রায় ৩০০ জন কাজ করেছেন। অ্যানিমেশনটির ক্যারেক্টার ডিজাইন করেছেন আরাফাত করিম, সহকারী ক্যারেক্টার ডিজাইনার রফিউজ্জামান রিদম, লিড ক্ইন কালার মনিরা আলম আশা। চিত্রনাট্য তৈরিতে শেখ মুজিব আমার পিতা ও অসমাপ্ত আত্নজীবনী প্রধান উপজীব্য হিসেবে কাজ করেছে। চিত্রনাট্য করেছেন চিশতি কানন ও ফাহাদ ইবনে কবীর। গবেষণার সমন্বয় করেছেন তন্ময় আহমেদ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন মুকুল। 

মুজিব আমার চলচ্চিত্রটিতে সোহেল মোহাম্মদ রানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের  ছোটবেলা থেকে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা পর্যন্ত দেখিয়েছেন। মূলত শেখ হাসিনার বয়ানেই বর্ণনা করা হয়েছে।

মুজিব আমার পিতার সাফল্য ও বাংলাদেশের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে এর অবদান সম্পর্কে সোহেল রানা বলেন, ‘এখন আমরা বলতে পারি যে আমাদের পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তরুণরা এখন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করার পথ পেয়ে যাবে সহজেই। আমি যতটা চ্যালেঞ্জ সম্মুখীন হয়েছি, তা এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।’ 

মুজিব আমার পিতা চলচ্চিত্রটির কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। মার্চ মাসের ১৩ তারিখে বাংলাদেশ ফ্লিম আর্কাইভে মুজিব আমার পিতার কারিগরী প্রদর্শনী হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং মুজিব আমার পিতা অ্যানিমেশনটির কলা কুশিলবরা। অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটির মুক্তির সময় শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে বলে জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী।

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
গ্রেনাডাতেও ওয়েবস্টার-ক্যারির ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি