X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কী হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে?

শফিকুল ইসলাম
১৪ মে ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১৪ মে ২০২১, ১৭:০৪

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। নামে উদ্যান হলেও এটি মূলত বাঙালি জাতির একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন সংবলিত স্থান। বৈশিষ্ট্যের মিল থাকলেও দেশের অন্য কোনও উদ্যানের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোনও মিল নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এই উদ্যান থেকে। আবার ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল এই উদ্যানে।

জাতির জনক পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভাটিও করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পাশে থেকে যুদ্ধ শেষে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে  ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই উদ্যানে। এসব কারণেই উদ্যানটি দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক জায়গাও বটে— এমনটাই মনে করেন উদ্যানের সংশ্লিষ্টরা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নতুন করে সাজানো হচ্ছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প। ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ নামে এই কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থায়ন করা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে চার হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ব্যয়ের ২৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, যার পরিমাণ ৭ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। গত  ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভূত অগ্রগতি হয়েছে ৬২ শতাংশ।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চারটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে— ১. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা। ২. বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের মর্মস্পর্শী অনুভূতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। ৩. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণকে ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা এবং ৪. স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী মহৎপ্রাণ মানুষদেরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতা কমপ্লেক্সটি পুরোপুরি সম্পন্ন হলে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন দুই হাজার স্কুলগামী শিক্ষার্থীকে এখানে এনে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণসহ  স্বাধীনতার  ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।  এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শনে প্রতিদিন ৫০ হাজার দর্শনার্থী আসবেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।      

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, ১০০ একরের বেশি পরিমাণ জমির সীমানাজুড়ে এই কমপ্লেক্সে গড়ে উঠবে বিভিন্ন স্থাপনা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— ১. জাতির পিতা ব্ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণ। এর উচ্চতা হবে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। এবং  বেদি হবে ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। ২. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে। এর উচ্চতা হবে ১৫ ফুট ও বেদি ৮ ফুট। ৩. এখানে নির্মিত হবে ইন্দিরা মঞ্চ। এটির উচ্চতা, দৈর্ঘ ও প্রস্থ কত হবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। ৪. ভূ-গর্ভস্থ কার পার্কিং নির্মাণ করা হবে। এর ধারণ ক্ষমতা হবে ৫শ’ কার/জিপ। ৫. নির্মিত হবে সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন ওয়াটার ফাউন্টেইন। ৬. ৭টি ফুড কিয়স্ক। এখানে নারী, পুরুষ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক টয়লেট ফ্যাসিলিটিও থাকবে। এসব ফুড কিয়স্কে  দাঁড়িয়ে ক্রেতারা হাল্কা জাতীয় নাস্তা খাবেন ও বিশ্রাম নেবেন। ৭. এখানে থাকবে ওয়াকওয়ে। ৮. থাকবে একটি মসজিদ এবং ৯. ভূ-গর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ট্যাংক নির্মাণ করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাকৃতিক সবুজের সমারোহ ঠিক রাখতে ১৩শ’ নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে। এগুলো লাগানো সম্পন্ন হলে উদোনের বর্তমান সবুজ প্রকৃতি আরও  সবুজ ও গাঢ় হবে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে দেশের ইতিহাস ও বাঙালি জাতির আবেগের জীবন্ত দলিল। সেভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ স্থাপনাগুলো। পরিবেশ, প্রকৃতি ও ইতিহাসকে সমুন্নত রেখে নবরূপে গড়ে তোলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে জীবন্ত ইতিহাস। এখানে এলেই একজন মানুষের চোখের ফুটে উঠবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেভাবেই প্রণীত হয়েছে প্রকল্প। প্রকল্পটির একটি অংশের কাজ শেষ হলেও চলছে বাকি অংশের কাজ।  প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার পর যখন দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে, তখন এই কমপ্লেক্সটি হবে প্রতিটি বাঙালি নাগরিকের জন্য অহঙ্কার ও গৌরবের।

এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ইতিহাস ও প্রকৃতির সমন্বয়ে প্রকল্পের কাজ করছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনও হোটেল নির্মিত হচ্ছে না। এখানে বাঙালি জাতির ইতিহাস সমৃদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। এটি একদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, অপরদিকে দেশে ও দেশের বাইরের মানুষদেরকে বাংলাদেশের ইাতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেবে। এটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জীবন্ত দলিল ও বাঙালির আবেগ। পাশাপাশি শিশু পার্কও থাকছে, যা হবে আপনার এবং আমার অহঙ্কার ও গৌরবের বিষয়।’

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাবটিও এখানে  ছিল। পরবর্তীতে এটিকে রমনা রেসকোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসেবে ডাকা হতো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ময়দানটিকে কখনও কখনও ‘ঢাকা রেসকোর্স’ নামে ডাকা হতো এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। এটি একটি জাতীয় স্মৃতিচিহ্নও বটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ  এখানেই দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। রমনা রেসকোর্সের দক্ষিণে পুরনো হাইকোর্ট ভবন,  জাতীয় তিন নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দীর সমাধি (তিন নেতার মাজার) অবস্থিত। এর পশ্চিমে বাংলা অ্যাকাডেমি, আনবিক শক্তি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, পাবলিক লাইব্রেরি এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। উত্তরে বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রিম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্কের অবস্থান।

/এফএ/
সম্পর্কিত
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের‍্যাম্প নির্মাণে কাটতে হবে অর্ধশত গাছ, নাগরিক সমাজের বিক্ষোভ
সৌন্দর্যবর্ধনের বলি হচ্ছে গাছ, তাতেও অনিয়ম!
সর্বশেষ খবর
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
রামরুর কর্মশালায় বক্তারাঅভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা