X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

হামাসের যে রহস্যময় নেতাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে ইসরায়েল

বিদেশ ডেস্ক
০১ জুন ২০২১, ১০:১৪আপডেট : ০১ জুন ২০২১, ১০:১৯

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের একজন প্রভাবশালী একজন নেতা সম্প্রতি ইসরায়েলকে অশুভ পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তার অস্পষ্ট এক অডিও রেকর্ডিংয়ে বলা হয়েছিল, হামাসের দাবি মানা না হলে ইসরায়েলকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে। এই অডিও রেকর্ডিংটি ছিল হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ দেফ, কোনওভাবেই যার নাগাল পাচ্ছে না দখলদার বাহিনী।

ইসরায়েলের ফেরারি তালিকায় মোহাম্মদ দেফের নাম সবার ওপরে। গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম তার কোনও কথা শোনা গেছে।

মোহাম্মদ দেফের সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারিকে ইসরায়েল পাত্তা দেয়নি। এরপর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় টানা ১১ দিন ধরে নারকীয় তাণ্ডব চালায় দখলদার বাহিনী। হত্যা করা হয় অন্তত ২৫৩ ফিলিস্তিনিকে। নিহতদের মধ্যে ৬৬ শিশুও রয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বহু স্থাপনা। পাল্টা প্রতিরোধ হিসেবে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে চার হাজারেরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। এতে ইসরায়েলের এক সেনাসদস্যসহ ১৩ জন নিহত হয়। ১১ দিনের সংঘাতের পর এক পর্যায়ে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় উভয় পক্ষ। এ যুদ্ধবিরতিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দাবি করে হামাস। ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে রাজপথে নেমে আসে গাজাবাসী।

জাতিসংঘ বলছে, গাজায় নিহতদের মধ্যে ১২৯ জনই বেসামরিক মানুষ। তবে ইসরায়েলের দাবি, নিহতদের মধ্যে ২০০ জনই ছিল ‘জঙ্গি’। গাজার হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার অবশ্য জানিয়েছেন, তাদের ৮০ জন যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।

ইসরায়েল এই লড়াইয়ের সময় মোহাম্মদ দেফকেও হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বিফলে যায়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই যিলবারম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘এই পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ দেফকে হত্যার চেষ্টা করেছি।’

আইডিএফের কর্মকর্তারা বিবিসি-র কাছে নিশ্চিত করেছেন যে, মোহাম্মদ দেফকে হত্যার জন্য অন্তত দুইটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এবারও তাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মোহাম্মদ দেফ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলা হচ্ছে, গত দুই দশকে ইসরায়েল এ নিয়ে মোহাম্মদ দেফকে হত্যার জন্য অন্তত সাত বার বিফল চেষ্টা চালিয়েছে।

মোহাম্মদ দেফকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হতাশ। সর্বশেষ লড়াইয়ের সময়েও তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের সব শীর্ষ সামরিক অধিনায়ককে হত্যা করা। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ম্যাথিউ লেভিট বলেন, ‘এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, হামাসের সামরিক সক্ষমতার পেছনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের একটা তালিকা ইসরায়েলের কাছে আছে। এই তালিকায় সবার ওপরে রয়েছেন মোহাম্মদ দেফ।’

‘গাজার অতিথি’

মোহাম্মদ দেফ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সেটি মূলত ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, তার জন্ম ১৯৬৫ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন মিসরের দখলে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি। কিন্তু ইসরায়েলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবনযাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন 'দেফ' নামে, আরবিতে যার অর্থ 'অতিথি।'

বহু দশক ধরে চলতে থাকা প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম। হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেফ একজন তরুণ। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি হামাসে যোগ দেন। হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। দলটির সামরিক শাখা 'ইজেদিন আল-কাসেম ব্রিগেড'-এ মোহাম্মদ দেফ বেশ দ্রুত ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সন্ত্রাসবাদবিরোধী একজন উপদেষ্টা মিস্টার লেভিট। তিনি বলেন, ‘তাকে বেশ কট্টরপন্থী হামাস কর্মকর্তা বলেই মনে করা হয়।’ তিনি জানান, মোহাম্মদ দেফ হামাসের খুব কট্টরপন্থী কিছু অধিনায়কের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন ইয়েহিয়া আইয়াশ। তিনি ছিলেন বেশ দক্ষ বোমা প্রস্তুতকারক, তাকে লোকে চিনতো 'ইঞ্জিনিয়ার' নামে। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ইসরায়েলে যাত্রীবাহী বাসে অনেকগুলো বোমা হামলার জন্য আইয়াশকে দায়ী করা হয়। ১৯৯৬ সালে ইসরায়েল তাকে হত্যা করে। কিন্তু এর ঠিক পরেই ইসরায়েলে বাসে আরও অনেকগুলো বোমা হামলা হয়। মোহাম্মদ দেফ ছিলেন আইয়াশের শিষ্য। অভিযোগ উঠে, প্রতিশোধ হিসেবে তিনিই এসব হামলা পরিচালনা করেছেন।

এই ঘটনার পর মোহাম্মদ দেফ হামাসের সামরিক শাখায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ২০০২ সালে দলটির সামরিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দীন শেহাদেহকে হত্যার পর নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।

হামাসের যে বিখ্যাত 'কাসাম রকেট', সেটির পরিকল্পনা এবং তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ দেফকে। গাজার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও নাকি মোহাম্মদ দেফের পরিকল্পনা। তিনি নাকি বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যে কাটান। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

নয় বার প্রাণে বেঁচে গেছেন যেভাবে

ইসরায়েলি নজরদারিকে ফাঁকি দেওয়ার ওপরই যেন নির্ভর করে মোহাম্মদ দেফের জীবন। ২০০০ সালের পরবর্তী কয়েক বছরে তাকে হত্যার জন্য ইসরায়েলিরা চার দফা চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় তিনি আহত হলেও পালাতে সক্ষম হন। ইসরায়েলি রিপোর্ট অনুযায়ী, তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরের কয়েকটি অংশ উড়ে গেছে।

২০০৬ সালে ইসরায়েলের হামলায় মোহাম্মদ দেফ যে গুরুতর আহত হয়েছেন সেটা নিশ্চিত করেছেন আইডিএফের এক সাবেক গোয়েন্দা প্রধান। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘লোকে ভেবেছিল মোহাম্মদ দেফ আর নেতা হিসেবে বা একজন সামরিক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি সেরে উঠেন।’

ইসরায়েলের এসব হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ দেফের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তাকে তার শত্রুপক্ষ বর্ণনা করতে থাকে 'নয়বারের জীবন পাওয়া বিড়াল' হিসেবে। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সময় তার ওপর পঞ্চম হামলাটি চালানো হয়। গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকায় একটি বাড়ির ওপর ইসরায়েলিরা বিমান হামলা চালায়। হামলায় মোহাম্মদ দেফের স্ত্রী উইদাদ এবং তাদের শিশুপুত্র আলি নিহত হয়। ইসরায়েলিরা ভেবেছিল, তারা মোহাম্মদ দেফকেও হত্যা করতে পেরেছিল। কিন্তু তিনি আসলে তখন সেই বাড়িতে ছিলেন না।

ওই হামলার পরপরই হামাস জানিয়েছিল, মোহাম্মদ দেফ এখনও বেঁচে আছেন এবং তিনিই হামাসের সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহাম্মদ দেফ যে বারবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারছেন তার কারণ তিনি আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার একেবারেই এড়িয়ে চলেন। মিস্টার লেভিট বলেন, ‘যদি আপনি ফোন ব্যবহার না করেন, কম্পিউটার ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনি কোথায় আছেন, সেই ধারণা পাওয়া আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য খুব কঠিন হবে।’ ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান বলছেন, মোহাম্মদ দেফকে হত্যার চেষ্টা যে ব্যর্থ হচ্ছে তার অনেক কারণ আছে। হামাসের টানেলগুলো যে রকম গভীর এবং বিস্তৃত এবং তার সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য এতো পুরনো, সেটা তাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করছে। এছাড়া কিছু হত্যা প্রচেষ্টার সময় অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করেনি।

অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার একদিন আগে হামাসের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানিয়েছিলেন, গাজায় লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ দেফ। আর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, মোহাম্মদ দেফের ব্যাপারে তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এসব মিশন যেহেতু বেশ গোপনীয়, তাই তারা এর বেশি তথ্য দিতে পারছেন না।

ম্যাথিউ লেভিট বলেন, মোহাম্মদ দেফকে নিয়ে ইসরায়েল যে এতো বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, সেটা তাকে অবাক করছে না। কিন্তু যেভাবে তিনি বার বার হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাচ্ছেন, সেটা তাকে ঘিরে রহস্য আরও বাড়াবে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল তার শেষ দেখতে আগ্রহী, কারণ তিনি হামাসের পুরনো ধারার একজন। দলটির একেবারে শুরু থেকে যারা ছিলেন, তাদের গুটিকয় এখনও আছেন। তিনি সেই অল্প কয়েকজনের একজন। সেদিক থেকে মোহাম্মদ দেফ অনন্য।’

মোহাম্মদ দেফের জীবন নিয়ে রহস্য অনেক। গাজার রাস্তায় পর্যন্ত তাকে দেখে চিনতে পারবেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করা হলো, তখন কিছু ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ দেফের নাম ধরে স্লোগান দেয়। গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা উদযাপনকালে তারা বলছিলেন, ‘দেফ, আমাদের আত্মা এবং আমাদের রক্ত দিয়েই আমরা তোমাকে মুক্ত করবো।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।

/এমপি/
সম্পর্কিত
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
সর্বশেষ খবর
বার্সা চায় শিরোপার দৌড়ে ফিরতে, আরও কাছে যাওয়ার বাসনা রিয়ালের
এল ক্লাসিকোবার্সা চায় শিরোপার দৌড়ে ফিরতে, আরও কাছে যাওয়ার বাসনা রিয়ালের
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল