X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘টিকটক হ্যাংআউটে’ তরুণী বাছাই, ছেঁড়া কাপড়ে সীমান্ত পার

আমানুর রহমান রনি
০৭ জুন ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৮ জুন ২০২১, ১৬:২৬

বাংলাদেশ থেকে পাচারের জন্য তরুণীদের সীমান্ত এলাকায় ছেঁড়া ও পুরনো কাপড় পরিয়ে নেওয়া হয়। যাতে স্থানীয় লোকজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওই এলাকার বাসিন্দা মনে করে। সীমান্ত পার হলেই হলো। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় গন্তব্যে। পাচারের জন্য এমন সব সীমান্ত এলাকা বেছে নেওয়া হয়, যেখানে দুই দেশেরই কাছাকাছি বসতি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য।

তবে এসবের আগে তরুণীদের আস্থা অর্জনই থাকে পাচারকারীদের লক্ষ্য। একবার আস্থা তৈরি হলেই কৌশলে তরুণীদের নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের গ্রামে। একজনকে পাচারে লেগে যায় দুই থেকে তিন বছরও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ‘তরুণীদের সীমান্ত পার করতে নানা ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। এতে করে তাদের স্থানীয়দের মতোই মনে হয়। মানবপাচারকারীরা এ কাজে বেশ কৌশলী।’

এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে ছয়জন তরুণীকে ভারতে একসঙ্গে পাচার করা হয়। যাদের প্রত্যেককেই সীমান্ত এলাকায় ছেঁড়া-পুরনো কাপড় পরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দুপুরের কোনও এক ফাঁকে তারা সীমান্ত পার হয়।

ওই ছয় তরুণীর একজন সম্প্রতি দেশে ফিরে আসার পর বের হয়ে এসেছে এসব কৌশলের বৃত্তান্ত। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ওই তরুণী জানিয়েছেন ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার কথা।

হাতিরঝিলে টার্গেট করতো হৃদয়

২০১৯ সালের মার্চের কোনও এক সময় হাতিরঝিল মধুবাগ ব্রিজে ঘুরতে গিয়ে টিকটকার রিয়াদুল ইসলাম হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় বিক্রয়কর্মী এক তরুণীর। এই ঘটনার মাসখানেক পর বসুন্ধরা সিটিতে একটি দোকানে বিক্রয়কর্মীর পদে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে গেলে সেখানে হৃদয়ের সঙ্গে ওই তরুণীর আবার দেখা হয়। সেদিন একে অপরের মোবাইল নম্বর লেনদেন হয়। এরপর শুরু হয় ফোনালাপ।

২০১৯ সালে হৃদয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ২০২০ সালের দিকে এই তরুণী মৌচাকের একটি বুটিক হাউজে বিক্রয়কর্মীর চাকরি নেয়। খোঁজ পেয়ে হৃদয় সেখানে প্রায়ই দেখা করতে যেত। তরুণীকে ভালো চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেয় হৃদয়। নিজেকে টিকটক তারকা বলে।

কিছু দিন পর হৃদয় তরুণীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। তরুণী তা প্রত্যাখান করে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলে। হৃদয় শিগগিরই প্রস্তাব পাঠাবে বলে জানায়। এরপর ফেসবুকে যুক্ত দুজন। চলতে থাকে কথাবার্তা। একসময় প্রেমের সম্পর্ক হয়েই যায়।

টিকটক হ্যাংআউটে তরুণী বাছা।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ল্যান্ডপার্কে টিকটক হ্যাংআউট প্রোগ্রাম আয়োজন করে একটি গ্রুপ। হৃদয় ওই তরুণীকে সেখানে নিতে চায়। সবাই যাবে বলে তরুণীও রাজি হয়। ল্যান্ডপার্কের ওই পার্টিতে যায়। পার্টিতে ৭০/৮০ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেয়। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পার্টি চলে। হৃদয় তরুণীকে জানায় টিকটক করে টাকা আয় করার সুযোগ আছে। হৃদয় তাকে সব শেখাবে বলেও জানায়।

এরপর থেকেই হৃদয় ওই তরুণীকে বুটিক শপের চাকরি ছাড়তে চাপ দিতে থাকে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হলে, তরুণী বেকার হয়ে পড়ে। তখনও হৃদয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ওই বছরে ১৮ সেপ্টেম্বর হৃদয় ফের গাজীপুরে আফরিন রিসোর্টে টিকটকারদের একটি পুল পার্টিতে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।

বাকিরা বাসে গেলেও ৮/৯ তরুণীকে নিয়ে হৃদয় একটি মাইক্রোবাসে যায়। ওই পার্টিতে সারাদেশ থেকে ৭০০/৮০০ টিকটকার অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে মেয়ে ছিল দুই শতাধিক। ছেলেরা কেউ কেউ পার্টিতে টাকা দিলেও মেয়েদের কাছ থেকে পার্টি বাবদ কোনও টাকা নেওয়া হয়নি। হৃদয়ের কোনও এক ‘বড়ভাই’ সব খরচ বহন করেছে বলেও আলোচনা হয়। পার্টিতে হৃদয়ের সহযোগী মারুফ, ইমাম, সম্রাট, আবিদ, সাইফুল ও ইমন ছিল। সেখানে তারা অনেকেই মাদক সেবন করে। কেউ কেউ রিসোর্ট কক্ষে বান্ধবীসহ বিশ্রাম করে।

হ্যাংআউট থেকে সীমান্তে

টিকটকার হৃদয় ওই তরুণীকে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকের মাধ্যমে জানায় কুষ্টিয়ায় লালনের মাজারে টিকটকারদের আরও একটি হ্যাংআউট আছে। হৃদয়ের সঙ্গে  সে চাইলে যেতে পারে। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনটি বাস হাতিরঝিলের মোড়লবাড়ি থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। তরুণী রাজি হয়।

১৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে ওই তরুণী মোড়লবাড়ি গিয়ে কোনও বাস দেখতে পায় না। তখন হৃদয়কে সে ফোন দেয়। হৃদয় তরুণীর ফোন রিসিভ করে জানায়, রাতে বাস ছাড়ার টাইম বদলানো হয়েছে। তাকে না জানিয়ে সকাল ৭টায় বাস কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। টিকটকের অন্য তারকারা তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কাজটি করেছে।

তরুণীর সঙ্গে হৃদয়ও আফসোসের অভিনয় করতে থাকে। বলে, ওই পার্টিতে না যেতে পারলে তরুণীর অনেক ক্ষতি হবে, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। যেকোনও মূল্যে যেতে হবে কুষ্টিয়া। তরুণী তার সঙ্গে যাবে কিনা জানতে চায়। হৃদয়ের প্রস্তাবে এবারও রাজি হয় তরুণী।

শ্যামলী থেকে একটি বাসে ওঠে দুজন। তবে বাসটি কুষ্টিয়ার ছিল না। ছিল সাতক্ষীরার। সাতক্ষীরা নামার পর হৃদয় জানায় সে ভুল করে বাসটিতে উঠে পড়েছিল।

সাতক্ষীরায় পাচারকারীদের দ্বিতীয় স্তর

১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা পৌঁছে হৃদয় হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। টেনশনে থাকার ভান করে। অনেকবার মোবাইলে কথা বলে। এরপর একটি মোটরসাইকেলে করে একজন আসে। চালকের সঙ্গে হৃদয় কথা বলে। হৃদয় জানতে চায়, এখান থেকে দ্রুত কুষ্টিয়া যাওয়ার উপায় কী? মোটরসাইকেল চালক জানায়, সামনে একটি বাস আছে। সেটি যাবে। দুজনকেই মোটরসাইকেলে উঠতে বলে ওই চালক।

১০/১৫ মিনিট পর একটি বাড়ির সামনে থামে মোটরসাইকেল। সেখান থেকে নাকি একটু আগেই ওই দিনের শেষ বাসটিও কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেছে।

মানবপাচারকারীর বাড়িতেই রাখা হয় তরুণীকে

হৃদয় মোটরসাইকেল চালককে জানায়, আজকের রাতটি সাতক্ষীরার কোনও হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা। তার কাছে তিনশ টাকা আছে। ওই লোক জানায় এত কম টাকায় হোটেলে থাকা যাবে না।

একটা কিছু করার অনুরোধ করে হৃদয়। পাশের একটি বাড়ি দেখিয়ে ওই চালক বলে, ওই বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকা যাবে কম খরচে। তরুণী প্রথমে রাজি হয়নি। হৃদয়ের অনুরোধে রাজি হয়।

তিন নম্বর জাল

হৃদয় ও তরুণী ওই বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান আরও ছয়জন তরুণ-তরুণী সেখানে রয়েছে। আলম নামে এক ব্যক্তি তার দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে এই বাড়িতে থাকেন। তরুণী ধারণা করেন, বাড়িটি তারই।  দুই তরুণীকে এক কক্ষে এবং হৃদয়সহ অপর তরুণদের অন্য কক্ষে থাকতে দেন বাড়ির মালিক আলম।

শেষবারের বাছাই

রাত আড়াইটার দিকে দুই তরুণীকে ঘুম থেকে তোলে হৃদয়। এসময় হৃদয়ের সঙ্গে আনিস নামের ৪০/৪৫ বছরের এক লোকও ছিল। দুই তরুণীকে সে ভালো করে দেখে। দেখা শেষে চলে যায়। এরপর দুই তরুণী আবার ঘুমিয়ে পরে।

আনিস মূলত তাদের চেহারা ও গঠন দেখে চূড়ান্ত যাচাই করে পাচারের জন্য। ২০ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টার দিকে ফের হৃদয় দুই তরুণীকে দরজা খুলতে বলে। তাদের দ্রুত রুম থেকে বের হতে বলে। এরপর আরেকটি বাড়িতে রাখা হয় তাদের। সেখানে তারা দরজা বন্ধ করে রাখে সকাল পর্যন্ত । ‘পুলিশ আসছে’ এমনটা জানিয়ে দরজা খুলতে নিষেধ করে হৃদয়। সকাল ৮টার দিকে এক মধ্যবসয়ী লোক ওই তরুণ-তরুণীদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে।

সীমান্ত ঘুরে দেখার টোপ

আব্দুল কাদের নামে যে লোকটি সকালে নাস্তা নিয়ে আসে, তিনি মূলত কৌশলে তরুণীদের সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখার টোপ ফেলেন। তরুণীদের জানান, কাছেই ভারতীয় সীমান্ত, অনেক মনোরম দৃশ্য, যারাই আসে তারাই ঘুরতে যায়।

হৃদয় তখন জিজ্ঞাস করার ভান করে, ‘তাই নাকি? ছবি তোলার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য আছে?’ কাদের জানায়, ‘অনেকেই দূর থেকে এখানে ছবি তুলতে আসে।’

হৃদয় কাদেরকে অনুরোধ করে তাদের বর্ডারের কাছে নিয়ে যেতে। যাতে টিকটকের জন্য ভালো ভিডিও বানানো যায়। আব্দুল কাদের তখন তাদের বর্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয়।

ছেঁড়া কাপড় পরে সীমানায়

ওই দিন (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে আব্দুল কাদের দুই তরুণীর জন্য দুই সেট ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে আসে। তরুণীদের পরতে বলেন। জানান, নতুন জামা পরে বর্ডারে যাওয়া যাবে না। তরুণীরা সেটাই পরে।

এরপর মেহেদী হাসান বাবু ও মহিউদ্দিন নামে দুই তরুণ মোটরসাইকেলে করে আলমের পাশের ওই বাড়িতে আসেন। তারা তরুণ-তরুণীদের দ্রুত তৈরি হতে বলেন।

হৃদয়সহ তিন তরুণ দুই তরুণী মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদেরে সঙ্গে সীমান্তের দিকে হাঁটতে থাকে। ১০-১৫ মিনিট পর এক জায়গায় আরও চার তরুণীসহ আনিস ও হারুনসহ দেখতে পান ঢাকা থেকে হৃদয়ের সঙ্গে যাওয়া তরুণী। এবার তারা একসঙ্গে ছয় তরুণী, হৃদয়, মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন, আব্দুল কাদের, হারুন, আনিসসহ আট তরুণ একসঙ্গে ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে থাকে। তখনও তরুণীদের মনে সন্দেহ জাগেনি।

আনিস হৃদয়কে জানায়, তাদের কোনও সমস্যা হবে না, সামনে বলে রেখেছে সে। তারা কিছুদূর যাবার পর আনিস ও আব্দুল কাদের এবং এক তরুণীর সঙ্গে থাকা তিনজন ছেলে চলে যায়। মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুনের সঙ্গে হৃদয়সহ ৬ জন মেয়ে হাঁটতে থাকে। ৩০-৪০ মিনিট পর সীমান্তের সামনে তারা বসে থাকে। সেখানে কোনও তারকাঁটার বেড়া ছিল না। কোথায় আছে তাও বুঝতে পারছিল না তরুণীরা।

হৃদয় তরুণীদের জানায় ভারতীয় সীমানায় ঢুকে সে সেলফি তুলবেই। সে ফিরে যাবার পাত্র নয়। যতক্ষণ লাগবে লাগুক।

প্রায় ২ ঘণ্টা বসে থাকার পর মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও হারুন সবাইকে একটা পাকা রাস্তায় উঠে হাঁটতে বলে। রাস্তার মাথায় দাঁড়ানো ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। হৃদয়সহ ৬ তরুণীকে লোকটির কাছে যেতে বলা হয়। তরুণীরা তার কাছে গেলে ওই ব্যক্তি তাদের সবাইকে রিসিভ করে দ্রুত অনুসরণ করতে বলে। এরপর রাস্তা ছেড়ে লোকটি জমি ধরে হাঁটতে শুরু করে।

ঢাকা থেকে যাওয়া তরুণীরা কিছুটা ভয় পেয়ে হৃদয়কে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমরা এখনও বাংলাদেশে আছি। অথচ তারা তখন ভারতে। জমি ও ক্ষেতের আইল দিয়ে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা হাঁটার পর লুঙ্গি পরা একজনের কাছে ট্রাউজার পরা ব্যক্তিটি সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। আর এতেই তরুণীরা পাচার হয়ে গেলো ভারতে।

পাচারের পর

ভারতে প্রবেশের পর মোটরসাইকেল যোগে তরুণীদের নেওয়া হয় ওই দেশের পাচারকারীদের সীমান্তবর্তী আস্তানায়।

লুঙ্গি পরা লোকটির সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর এক জায়গায় গিয়ে চারটি মোটোরসাইকেলসহ চারজনকে দেখতে পায় তারা। হৃদয় ঢাকা থেকে যাওয়া সেই তরুণীকে একটি কালো রঙের মোটরসাইকেলে উঠতে বলে। মোটরসাইকেলের চালকের নাম বকুল ওরফে ছোট খোকন।

ওই তরুণী ও হৃদয় ছোট খোকনের মোটোরসাইকেলে ওঠে। ১০-১৫ মিনিট যাওয়ার পর একটি টিনশেড বাসার সামনে নামে। মিনিট পাঁচেক পর আরেকটি মোটরসাইকেলে আরেক তরুণীকে সেখানে নিয়ে আসা হয়। ওই বাসায় তরুণীদের রেখে হৃদয় ও ছোট খোকন ঘুরতে বের হয়। সেই বাসার একজন নারী দুই তরুণীকে খাবার ও জামা-কাপড় দেয়। ক্লান্ত দুই তরুণী ওই বাসাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

শুরু হয় যৌন নির্যাতন

ভারতে নেওয়ার পরই ওই তরুণীদের শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয়। ধর্ষণ করা হয় বেশ ক’বার। বদ্ধ ঘরে অনেকের সামনে তাদের ধর্ষণ করা হয়। হোটেলে যাতে তারা এই যৌন নির্যাতন সহ্য করে সেজন্য আগে থেকেই তাদের ওপর চালানো হয় নৃশংসতা।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছোট খোকন এসে ভারতের যে বাড়িতে ওই দুই তরুণীকে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে এক তরুণীকে নিয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর ছোট খোকন আবার এসে ঢাকা থেকে যাওয়া তরুণীকে জানায় হৃদয় খুব কান্নাকাটি করছে। এ বলে তাকেও নিয়ে যায়। রাখা হয় একটি অন্ধকার রুমে। যেখানে আগের সেই তরুণীও ছিল।

এরপর সেই রুমে দুজনই চিৎকার করে কাদঁতে থাকে। দুই তরুণীর কান্নাকাটির কারণে ছোট খোকন রাতে তাদের নিজের বাসায় নিয়ে রাখে। তারা তখনও জানে না যে তারা ভারতে আছে। পরদিন সকালে বকুল এক তরুণীকে বাসা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়।

ঢাকা থেকে যাওয়া তরুণীকে খোকনের বাসায় রাখা হয়। রাতে হৃদয়ের অজুহাত দেখিয়ে তাকে আবার অন্য একটি বাসায় নিয়ে যায় ছোট খোকন। সে বাসায় হৃদয় ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এলাকাটি কোথায় তা তরুণী নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে ভারতের চব্বিশ পরগনার কোনও একটি এলাকা হবে সেটা।

তরুণীদের আধার কার্ড

ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র খ্যাত আধার কার্ড বানানোর জন্য ছোট খোকন তরুণীর ছবি তোলে এবং তথ্য লিখে নেয়। এরপর তরুণীর ভাষ্যে, ‘হৃদয় ও ছোট খোকন দুজন মিলে আমাকে জোর করে ওই বাসাতেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে। তরুণী বুঝতে পারে হৃদয় কৌশলে তাকে ভারতে পাচার করেছে। সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তরুণী চিৎকার করে আশেপাশের লোকজন ও পুলিশকে জানাতে চাইলে হৃদয় ও ছোট খোকন জানায়, পাসপোর্ট ছাড়া অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার কথা পুলিশ জানতে পারলে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। বিশ বছরের জেল হবে। তরুণী এ সময় কান্নাকাটি করতে থাকে। শেষরাতে তারা দুজন আবার ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে। সকালে ছোট খোকন রাতে নিয়ে যাওয়া তরুণীকে নিয়ে আসে। সে কাঁদতে কাঁদতে জানায় গতরাতে তিনজন তাকে ধর্ষণ করেছে।

মূল গন্তব্য বেঙ্গালুর বা চেন্নাইয়ের হোটেল

এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছোট খোকন ও হৃদয় দুই তরুণীকে আধার কার্ড ও ব্যাঙ্গালুরুগামী ভারতের অভ্যান্তরীণ বিমানের টিকিট ধরিয়ে দেয়। দমদম থেকে হৃদয় ও দুই তরুণী Indigo Airlines-এর ফ্লাইটে ব্যঙ্গালুরু যায়। বিমানবন্দরে সবুজ ও রুবেল নামে দুই তরুণ তাদের রিসিভ করে।

হৃদয়সহ দুই তরুণীকে রুবেল ওরফে রাহুল ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুরা সার্কেলে তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসাটিতে রুবেল ও তার স্ত্রী সোনিয়া থাকে। সেখানে দুই তরুণী ও হৃদয়কে দশ দিন রাখা হয়। এসময় হৃদয় ও রাহুল বাসা থেকে বের হলেও তরুণীরা বাসার ভেতরেই থাকতো। তাদের তালা মেরে আটকে রাখা হতো।

রুবেলের স্ত্রী সোনিয়ার কাছে সাহায্য চায় তরুণীরা। সোনিয়া উল্টো ডাবল তালা মারার ব্যবস্থা করে। এরপর হৃদয়সহ ঢাকা থেকে যাওয়া তরুণীকে আনন্দপুরা সার্কেলের একটি পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে বাসায় আগে থেকেই আরও দুই তরুণী ছিল। তাদের বাড়িও বাংলাদেশে।

পরের দিন সেখান থেকে এক তরুণীকে হায়দারাবাদের একটি আবাসিক হোটেলে পাঠানো হয়। এসময় অপর এক তরুণী কান্নাকাটি করে। সে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। সবুজ তাকে প্রচণ্ড মারধার করে অন্য একটি বাসায় নিয়ে যায়। ৪-৫ দিন পর সাগর, হৃদয়, আকিল ও ডালিম ঢাকা থেকে যাওয়া তরুণীকে জানায়, তার জন্য কাজ ঠিক করা হয়েছে, কাজে যেতে হবে। এ সময় হৃদয়, সাগর ও সবুজ তাকে মারধর করে। তরুণীকে  একটি হোটেলে পাঠাতে চাইলে সে যেতে রাজি হয় না। এরপর আবার মারধর চলে। চিৎকার শুরু করলে হৃদয় ও সাগরের সামনে সবুজ তরুণীকে ধর্ষণ করে। এ সময় হৃদয় তরুণীদের নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। হৃদয় বলে, তাদের কথামতো না চললে ছবি ও ভিডিও তরুণীর পরিবারের সদস্যসহ ঢাকায় পরিচিত সবাইকে পাঠিয়ে দেবে।

৩-৪ দিন পর হৃদয়, সবুজ ও সাগর তরুণীদের একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে চেন্নাইয়ের OYo Hotel রেখে আসে। প্রথমদিনই ওই তরুণীকে ১৯ জনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয়। এতে তরুণী অসুস্থ হয়ে হোটেলের লোকজনের সাহায্য চায়। লোকজন তাকে জানায়, দিনে ৩০টি কাজ করতে হবে। পাঁচদিন পরই তরুণী প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। হোটেলের লোক ফোন করলে হৃদয় ও সবুজ ওই তরুণীকে নিতে আসে।

ওরা দুজন তরুণীকে আনন্দপুরা সার্কেলের বাসায় নিয়ে যায় । সেখানে তরুণী দেখতে পায় হৃদয় ঢাকা থেকে আরও চার তরুণীকে নিয়ে গেছে। তাদের বাড়িতে একই কক্ষে রাখা হতো। একই জায়গায় ঘুমাতো। ২৭ মার্চ ভোরে হৃদয় তরুণীদের কক্ষে ঢুকে এক তরুণীকে সবার সামনে ধর্ষণ করতে চায়। এসময় ঢাকা থেকে হৃদয়ের সঙ্গে যাওয়া তরুণী তাকে বাধা দেয়। হৃদয় তাকে মদের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে ওই তরুণীর মাথা ফেটে যায়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চারটি সেলাই দিতে হয়।

অসুস্থ অবস্থাতেই সবুজ, হৃদয়, সাগর ও আকিল ওই তরুণীকে হোটেলে পাঠানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। এ ছাড়াও অপর তরুণীদের বিভিন্ন মাসাজ পার্লার ও হোটেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দুই তরুণী পালিয়ে যায়। একে একে কয়েক তরুণী পালাতে সক্ষম হয়। ৩ মে আনন্দপুরা সার্কেলের বাসা থেকে হৃদয়ের সঙ্গে যাওয়া তরুণীকে চেন্নাই একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই হোটেল থেকে ওই তরুণী পালিয়ে কলকাতা যায়। ৭ মে সে দালাল ধরে বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়।

ওই তরুণী দেশে ফিরে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় হৃদয়সহ অন্যদের আসামি করে একটি মামলা করে। মামলাটি তদন্তাধীন। পুলিশ ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা ও ঢাকা থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশর তেঁজগাও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক জানিয়েছে, নারীপাচার চক্রটি এই রুটে এভাবে কত নারী পাচার করেছে তা তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে।

/এফএ/
সম্পর্কিত
টিকটক নিষিদ্ধ হলে লাভবান হবে ফেসবুক: ট্রাম্প
দেশে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে যা জানা গেলো
নির্বাচনে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে টিকটক
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!