X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
জরিপ হয়নি পাঁচ বছর

দেশে শিশুশ্রমিক কত কেউ জানে না

শফিকুল ইসলাম
১২ জুন ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১২ জুন ২০২১, ০৯:০০

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ও ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের আইন থাকলেও দেশের কোন খাতে কত শিশুশ্রমিক কাজ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এতে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

১৪ বছরের কমবয়সী কোনও শিশুকে কোনও কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকারি আইনে নিষেধ করা হলেও চলছে এ নিয়োগ। এখনও দেশের বহু বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুরা কাজ করছে। কাজ করছে হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে।

জরিপ হয়নি পাঁচ বছরেও

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত ছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। বাকিদের কাজ অনুমোদনযোগ্য।

এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছিল ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট হুমকিস্বরূপ।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় এমন তথ্য পাওয়া গেলেও ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সমীক্ষাটি চূড়ান্ত করে বিবিএস। এরপর শিশুশ্রম নিয়ে আর কোনও জরিপ কেউ করেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

শিশুশ্রম বন্ধের কোন মন্ত্রণালয়ের কী কাজ

এদিকে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে শিশুশ্রম নিরসনে ৯ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দায়িত্ব বণ্টন করে নয়টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। ২০১০ সালের জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতির আলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় ওই ৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দায়িত্ব বণ্টনও করা হয়েছে। সেই অনুসারে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের বিষয়টি দেখবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল কমিশন টু রিভিউ দ্য ওয়ার্কিং অফ দ্য কনস্টিটিউশন।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি দেখবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নের কাজ। সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন।

কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়টি দেখবে শ্রম মন্ত্রণালয়। আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, শ্রম মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়। শিশুশ্রম প্রতিরোধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগও কাজ করবে।

শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব থাকবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনগুলোর ওপর। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কাজ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুশ্রম বন্ধে বিদ্যমান আইনের পর্যালোচনা ও সংশোধন প্রয়োজন। তারা জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকৌশলে শিশুশ্রমকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

তারা বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রমিক কমবে না।

উল্লেখ্য, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ করা যাবে না।

পেশা বদলাচ্ছে শিশুরা

মহামারি করোনার কারণে শিশুশ্রমিকদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে এদের সংখ্যা মোট শিশুশ্রমিকের ৫০ শতাংশ। রাজধানীর কমলাপুর, মুগদা, ভাসানটেক ও মোহাম্মদপুর এলাকায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২৪০ শ্রমজীবী শিশুর ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে রোজগার কমে যাওয়ায় তারা পেশা বদলেছে। অনেকেই জড়িয়েছে ভিক্ষাবৃত্তিতে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট-এএসডি’র উদ্যোগে পরিচালিত ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাবে ঢাকায় কর্মরত শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যাচাই’ শীর্ষক এক জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতবছরের ৩০ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করে এএসডি।

জরিপের ফলাফলে জানা গেছে, করোনার বিরূপ পরিস্থিতিতে ঢাকায় শ্রমজীবী শিশুদের ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেসব শিশু আগে কাজ করতো তাদের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ বলছে, বর্তমানে তাদের কাজ নেই। তাদের ওপর তাদের পরিবারগুলো নির্ভরশীল বলেও জরিপে অংশ নেওয়া ৩১ শতাংশ শিশু জানিয়েছে।

এদিকে করোনাকালীন কাজ করলেও শিশুদের ৫১ ভাগ কাজে যাবার সময় মাস্ক ব্যবহার করেনি। জরিপকৃত শিশুর ৩২ শতাংশ করোনাকালীন সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা পায়নি বলেও জানিয়েছে।

শিশুশ্রমের যত সংজ্ঞা ও শিশুর অধিকার

কর্মরত শিশু, শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। ১৮তম শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য।

তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনও শিশু যদি কোনও ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, সেটাও শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে।

শিশুশ্রম বিষয়ে সাংবিধানিক ও আইনগত অবস্থানে জানা গেছে, (ক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ এবং ২০ অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

মৌলিক অধিকার অংশের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪১-এ মানুষ হিসেবে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। বিশেষত, জবরদস্তিমূলক শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অধিকার ক্ষুন্ন  হওয়ার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে প্রতিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।

(খ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর এ দেশে শিশু এবং শিশু অধিকার সংরক্ষণে প্রবর্তিত হয় শিশু আইন ১৯৭৪ (১৯৭৪ সালের ৩৯ নং আইন)। এ আইনে শিশুর সংজ্ঞা, বয়স, অধিকারের পরিধি, নাবালকত্ব, অভিভাবকত্ব, শিশুর সম্পদের হেফাজত, দেওয়ানি-ফৌজদারি মামালার ক্ষেত্রে শিশুর রক্ষাকবচ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তিৃত পরিমণ্ডলে আলোচিত হয়েছে। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ আইন একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক বলেও জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিতে বলা হয়েছে।

আর্থ-সামাজিক দুরাবস্থাও কারণ

জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ এ বলা হয়েছে- বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক দুরাবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ। গ্রামে কাজের সুযোগ কম, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব এসব কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।

নদী ভাঙন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও দায়ী। এ জাতীয় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনাই শিশুদের কায়িক শ্রমের ঠেলে দিচ্ছে। পিতামাতার স্বল্পশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অসচেতনতার কারণে শিশুরা পড়াশোনাকে একটি অলাভজনক কাজ মনে করে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জানিয়েছেন, সরকার শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করছে। শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে স্কুলগামী শিশুদের নগদ অর্থ, খাবারসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে সরকার। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধে শতভাগ সফলতা আসবে বলেও জানান তিনি।

/এফএ/
সম্পর্কিত
গৃহপরিচারিকার মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাকুলকে অপসারণের দাবি
শিশুশ্রম নিরসন ও পুনর্বাসন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের ওপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত
গৃহকর্মে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার আহ্বান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের
সর্বশেষ খবর
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন