বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু ২০২৪ সালে শিশুশ্রমে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত; যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বৃহস্পতিবার (১২ জুন) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস ও আন্তর্জাতিক খেলা দিবস উপলক্ষে ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২৪, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন হলেও প্রতিবেদনে একটি কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে—এখনও লাখ লাখ শিশু শিক্ষা, খেলা এবং শুধু শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিশুশ্রম কমার চিত্র দেখা গেলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০১৩ সালে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু)। কিন্তু একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে।
ক্ষতিকর কাজে যুক্ত বৃহত্তর শিশুশ্রমের হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে—২০১৩ সালে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে সামান্য বেড়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ এখনও ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষে পৌঁছাতে সঠিক গতিতে নেই। শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বাস্তবতা পরিবর্তনে বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজন স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনের তথ্য এবং বাংলাদেশে থেকে পাওয়া তথ্য একইসঙ্গে আমাদের উৎসাহ যোগায় এবং এই সংকটের সমাধান করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাসে অগ্রগতি আমরা স্বীকার করি, তবে সামগ্রিক শিশুশ্রমের হার একই রকম থাকায় এটি স্পষ্ট—আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদান জোরদার করতে হবে, সব শিশুর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার সার্বজনীন সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং সমাজসেবা, বিশেষ করে শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। শিশুদের স্থান স্কুল ও খেলার মাঠে, কর্মক্ষেত্রে নয়। তাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি জরুরি।’
শিশুশ্রম শিশুর শিক্ষা ব্যাহত করে, তাদের অধিকার খর্ব করে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনে। এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। শিশুশ্রমের মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, যার ফলে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়—সেইসঙ্গে বঞ্চনার বংশপরম্পরাগত চক্র স্থায়ী হয়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী তথ্য অনুযায়ী, কৃষিখাত এখনও শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র—শিশুশ্রমের ৬১ শতাংশ ঘটে এই খাতে। এর পরেই রয়েছে সেবা খাত (২৭ শতাংশ), যেমন গৃহস্থালি কাজ বা বাজারে পণ্য বিক্রি এবং শিল্প খাতে রয়েছে (১৩ শতাংশ), যার মধ্যে খনি ও উৎপাদন শিল্প অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আইএলও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অফিসার ইনচার্জ) গুঞ্জন ডালাকোটি আইএলও কনভেনশন নম্বর ১৩৮ ও ১৮২ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরেন। আইএলও’র এই দুই কনভেনশন বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি জাতীয় আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, অর্থপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে হলে কমিউনিটি, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, এনজিও ও সংবাদমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আইএলও’র অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শিশুশ্রম থাকলে সেখানে যথাযথ শ্রমের পরিবেশ থাকে না। তিনি একইসময় প্রতিটি শিশুর জন্য একটি নিরাপদ, শিক্ষার সুযোগ সংবলিত শৈশব নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
ইউনিসেফ ও আইএলও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে সরকার ও অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে—
১। অসহায় পরিবারগুলোর জন্য জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে; যাতে তাদের শিশুশ্রমের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এর মধ্যে সার্বজনীন শিশু ভাতার মতো সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
২। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে; যাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের চিহ্নিত করা যায়, শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা যায় এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা দেওয়া যায়—বিশেষ করে যারা চরম শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে রয়েছে।
৩। প্রতিটি শিশুর জন্য সার্বজনীন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও সংকটাপন্ন এলাকায়।
৪। প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণদের জন্য সম্মানজনক কাজ এবং উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করতে; যাতে কর্মস্থলে অধিকার এবং সম্পদের অ্যাক্সেসও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৫। শোষণ বন্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং সাপ্লাই চেইনের সর্বত্র শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে আইন প্রয়োগ ও ব্যবসায়িক জবাবদিহিতা জোরদার করতে।
২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, ২৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১৩ কোটি ৮০ লাখ হয়েছে। তারপরেও শিশুশ্রম কমার বর্তমান গতি ধীর এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূল করতে হলে বর্তমানে যে গতি রয়েছে—তা ১১ গুণ দ্রুততর হতে হবে।