X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘সুফল’ প্রকল্প কতটা সফল?

এমরান হোসাইন শেখ
০৯ জুলাই ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২১, ১৮:১৪

কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাচ্ছে না 'টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)' প্রকল্প। বন অধিদফতরের পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটির তিন বছরে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের শর্ত মেনে এখনও পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়নি এতে। পরিচালক নিয়োগে সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। প্রকল্পে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও কোনও কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রকল্পভুক্ত এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সরকারি বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ‘সুফল’ প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাইতে। বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, বনজ সম্পদ উজাড় রোধ ও বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকার সংস্থানও এ প্রকল্পের লক্ষ্য।

প্রকল্পে যা আছে
২৮টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ বন অধিদফতর। এর আওতায় আছে ৫টি বনাঞ্চল। আট বিভাগের ২৮ জেলার ১৬৫টি উপজেলার ৬০০ গ্রাম এতে সম্পৃক্ত।

প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-নতুন করে ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বনায়ন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও চলাচল পথের (করিডোর) উন্নয়ন, বিপন্ন বন্যপ্রাণী (হাতি, শকুন, চামচঠুঁটো বাটান, শার্ক রে, ঘড়িয়াল, ডলফিন ও বাঘ) সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার লাল তালিকাকরণ, কিছু স্থাপনা নির্মাণ, বনাঞ্চলের আশাপাশের বননির্ভর ৬০০ গ্রামের ৪০ হাজার পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের জাতীয় বনাঞ্চল ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে বলেও জানানো হয়েছে।

যা যা হওয়ার কথা ছিল
নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় অগ্রগতি থমকে আছে বলে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়। কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে ১০ মাস দেরি হয়েছে বলে জানানো হয়।

প্রকল্প অনুযায়ী প্রথম তিন অর্থবছরে প্রায় এক হাজার ১৫৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ছাড়ের কথা ছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৩৪ কোটি ৮২ লাখ আট হাজার টাকা।

পণ্য, কার্য, সেবা মিলে ক্রয় অগ্রগতি মাত্র ২৪ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় ১৬২টি প্যাকেজ ক্রয়ের সংস্থান থাকলেও ৮৮টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ২৫টির দরপত্র প্রক্রিয়াধীন। বাকি ৪৯টির প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। চুক্তি হয়েছে ৩৭টি প্যাকেজের।

প্রকল্পের কেনাকাটা শুরু করতে ১৬ মাস দেরি হয়েছে। ৯৩টি ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও মাত্র ৫টি ভবনের দরপত্র আহ্বানেই এ কাজ সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ৩২ ধরনের বনায়ন কার্যক্রমের ৫০ শতাংশ এবং ৬৩ লাখ ৫০ হাজার চারা উত্তোলন বিতরণের লক্ষমাত্রার বিপরীতে অগ্রগতির হার ৮৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। ৫১ লাখ বনজ/ফলজ চারা উত্তোলন ও বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অগ্রগতি ৪৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। ৫টি মডেল উপজেলায় পাঁচ লাখ চারা বিতরণ ও উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অগ্রগতি হয়েছে ৬২ শতাংশ।

সুফল প্রকল্পের আওতায় নার্সারি। সংগৃহীত ছবি

টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত চারা উত্তোলন ও বিতরণ কর্মসূচির কোনও কার্যক্রম এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের আওতায় বনবিভাগের চারা উত্তোলনের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ।

জানা গেছে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনাঞ্চল তথা অ্যাসিস্টেড ন্যাচারাল রিজেনারেশন (এএনআর)-এর অংশ হিসেবে দেশি প্রজাতির গাছ লাগানোর কথা রয়েছে প্রকল্প পরিকল্পনায়। ৭১ শতাংশ গাছ লাগানো হলেও যেসব গাছ লাগানোর কথা ছিল তার শর্ত মানা হয়নি। তাছাড়া এসব গাছের চারার ৪০ শতাংশ প্রথম বছরেই মারা গেছে। দ্বিতীয় বছরে কম্পোস্ট সার প্রয়োগের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এক কিলোমিটার এলাকার চারাগাছ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার তথ্যও উঠে এসেছে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে।

প্রকল্পের শর্তানুযায়ী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কিছু বনাঞ্চলে ৫৭৯০ হেক্টরে স্ট্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট বনায়ন করার কথা। আড়াই বছরে এর অগ্রগতি ১০ শতাংশেরও কম। যেসব চারা লাগানো হয়েছে সেগুলোর আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি। পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে ২০-৪০ শতাংশ চারা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম বছরে ধীর ও দ্রুত বর্ধনশীল মিশ্র বাগান তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি দ্বিতীয় বছরের ম্যানগ্রোভ বাগান তৈরিও।

প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্তপ্রায় ১০০ প্রজাতি নির্বাচন এবং ৫টি সংরক্ষিত এলাকায় আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ তথা-ইউক্যালিপটাস, আসামলতা, স্বর্ণলতা, ল্যান্টানা ও মটমটিয়ার জরিপ প্রথম পর্যায়ে শেষ হয়েছে। বিপন্ন প্রজাতির বন্য ও জলজ প্রাণী যেমন শকুন, ঘড়িয়াল, ডলফিন ইত্যাদি সংরক্ষণে পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের কথা থাকলেও তাতে অগ্রগতি নেই।

প্রকল্পের আওতায় ৪০ হাজার সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি। এ কাজে বেজলাইন জরিপ প্রতিষ্ঠান নিয়োগও হচ্ছে না। সুবিধাভোগী নির্বাচনে সাতটি এনজিওর সঙ্গে চুক্তির কথা থাকলেও মাত্র একটির নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্পে অনলাইন (ওপেন ডাটা কিট) পর্যবেক্ষণের সুবিধা চালু হলেও মাঠ পর্যায়ে দক্ষ জনবলের অভাবে তা কাজে আসছে না।

গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কমিউনিটি পেট্রোলিং, অফিস বিল্ডিং ও আবাসিক ভবন নির্মাণ, রেসকিউ বোট কেনা, বন্যপ্রাণী কেন্দ্রের জন্য সোলার লাইট স্থাপন, বন্যপ্রাণী জাদুঘর ও লাইব্রেরি স্থাপন, মাটি ভরাট ও উন্নয়ন, বন্যপ্রাণী অলিম্পিয়াড, ফরেনসিক ল্যাবের জন্য রিএজেন্ট কেনাসহ আরও অনেক কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।

প্রকল্পে হাতির বিচরণ বসতি এবং চলাচলের সময় জনগণের সঙ্গে সংঘাতের মাত্রা কমিয়ে আনার কার্যক্রম পৃথক সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কথা। সেই প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না দেওয়ায় এ জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।

মাঠ পর্যায়ে প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণমূলক পরিবীক্ষণ করার কথা থাকলেও তা হয় না। পরিবীক্ষণ চলাকালীন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১৯তম সভার আলোচ্যসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতির প্রতিবেদন চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন করে আইএমইডি যে সুপারিশ করেছিল তা এক মাসের মধ্যে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেটাও মানা হয়নি।

পরিকল্পনা বিভাগের নির্দেশ অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে নিয়মিত পরিচালক পদায়নের বিধান আছে। কিন্তু এ প্রকল্পে তা মানা হয়নি। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে একজন পূর্ণকালীন পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। দেড় বছরেও সেটার বাস্তবায়ন হয়নি। আড়াই বছরে প্রকল্প পরিচালক বদলেছে তিনবার।

প্রতি তিন মাস পর পর পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) ও পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট কমিটি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরে মাত্র দুটি করে সভা হয়েছে। অথচ এ সময় অন্তত ১১টি সভা হওয়ার কথা।

‘নাম ভালো, কাজ নয়’
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম বছরে কোনও অডিট আপত্তি না থাকলেও দ্বিতীয় অর্থবছরের ১৩টি আপত্তি এসেছে। আপত্তি সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ দুই কোটি টাকারও বেশি।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ‘সুফল’ প্রকল্পের অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে। কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ওই সময় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাদের নাম ভালো, কাজ তত ভালো নয়। প্রত্যাশার ধারেকাছেও নেই তারা।’

কমিটির সভাপতি বলেন, ‘এত বড় প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে ভিত শক্ত করতে হবে। কিন্তু পরিকল্পনার দিক থেকেও স্বস্তি খুঁজে পাইনি। বাস্তবায়ন তো পরের কথা।

তিনি বলেন, ‘প্রথম বছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টাকা খরচ করতে পারেনি তারা।’ অথচ হুলস্থুল করে গাড়ি কেনা শুরু করে দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পটির বিষয়ে তারা একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নিরপেক্ষ পরিবীক্ষণ করিয়েছেন। সেখানে অনেকগুলো ফাইন্ডিংস এসেছে। উনাদের কাজের ধীরগতি লক্ষ্য করেছি। অবশ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তারা সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবে। আমরা তাদের কাছে একটি রিভাইসড ওয়ার্কপ্ল্যান চেয়েছি।’

/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী